অতিথি - জয়ন্ত
আকাশটা স্তব্ধ হয়ে আছে।হয়ত আজ বৃষ্টি হবে খানিকক্ষণ। ঐ যে আকাশের কোণায় কয়েক থোকা মেঘ জমেছে মনে হচ্ছে ! আনন্দ ও বিষাদের একটি সংমিশ্রিত অদ্ভদ অনুভূতি লাভ করল তিথি। আনন্দের কারনটা অবশ্য বৃষ্টি। বৃষ্টি অতি প্রিয় তার কাছে। রাত্রির গায়ে গা ঘেঁষে বৃষ্টিস্নানের অনুমুতি অবশ্য সে পাবে না। কিন্তু জানালা দিয়ে দু হাত বাড়িয়ে মুঠো মুঠো জল নিয়ে খেলা করতে তো আর মানা নেই।আর দুঃখটা তার অন্য জায়গায়।সে নিজেও জানে না দুঃখটা কি।শুধু কেবল জানে, কিছু একটার জন্ম হচ্ছে তার ভিতরে।এটুকুও সে বেশ বুঝতে পেরেছে যে উপলব্ধি বাস্তবতায় রূপ নিতে এখনো ঢের দেরি।
আজ তিথির জন্মদিন।সকাল থেকেই অন্দরমহলে বেশ তোড়জোড় চলছে।তিথির সব পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। অতঃপর সন্ধ্যাবেলায় মা তিথিকে দু চামচ পায়েশ খাইয়ে পিঠ ঠেকিয়েছে বিছানায়।সব বন্ধুরাও বিদায় নিয়েছে এক এক করে। ঠাণ্ডা বাতাসে শরতের উপন্যাসটার পাতা একটি একটি করে উলটে যাচ্ছে, তবুও তিথির অপেক্ষার পালা এখনো শেষ হয়নি।গতকাল তিথি কতোবার চিৎকার করে বলেছিল,কাল কিন্তু জন্মদিন আমার।একবারটা যেন এদিকটায় আসা হয়,জন্মদিনের পায়েসটা অন্তত..................ইত্যাদি ইত্যাদি।তিথির চিৎকার শুনে তিথির বই ভর্তি টেবিলের পায়াগুলোর মধ্যে বসবাসরত ঘুণিপোকারা হয়ত কয়েকটা মুহূর্ত তাদের ডাক থামিয়েছিল,কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে তিথি তার গলার স্বরযন্ত্রের ব্যায়াম করেছিল,সে নির্বিকার ভঙ্গিতেই চলে গিয়েছিল। ক্ষীণ হাসি তার মুখে এসেছিলো কিনা তার খবর কেবলমাত্র অন্তরিক্ষের দ্বাররক্ষীই বলতে পারবে।
আজ তিথির জন্মদিন।সকাল থেকেই অন্দরমহলে বেশ তোড়জোড় চলছে।তিথির সব পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। অতঃপর সন্ধ্যাবেলায় মা তিথিকে দু চামচ পায়েশ খাইয়ে পিঠ ঠেকিয়েছে বিছানায়।সব বন্ধুরাও বিদায় নিয়েছে এক এক করে। ঠাণ্ডা বাতাসে শরতের উপন্যাসটার পাতা একটি একটি করে উলটে যাচ্ছে, তবুও তিথির অপেক্ষার পালা এখনো শেষ হয়নি।গতকাল তিথি কতোবার চিৎকার করে বলেছিল,কাল কিন্তু জন্মদিন আমার।একবারটা যেন এদিকটায় আসা হয়,জন্মদিনের পায়েসটা অন্তত..................ইত্যাদি ইত্যাদি।তিথির চিৎকার শুনে তিথির বই ভর্তি টেবিলের পায়াগুলোর মধ্যে বসবাসরত ঘুণিপোকারা হয়ত কয়েকটা মুহূর্ত তাদের ডাক থামিয়েছিল,কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে তিথি তার গলার স্বরযন্ত্রের ব্যায়াম করেছিল,সে নির্বিকার ভঙ্গিতেই চলে গিয়েছিল। ক্ষীণ হাসি তার মুখে এসেছিলো কিনা তার খবর কেবলমাত্র অন্তরিক্ষের দ্বাররক্ষীই বলতে পারবে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজেই চলেছে তিথি। প্রদীপের তেল টুকুন কখন যেন শেষ হয়ে যায়,তা দৃষ্টিগোচর হয় না তিথির। শুধু বুঝতে পারে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে আকাশের মসৃণ দেয়াল বেয়ে।হাত বাড়িয়ে দেয় তিথি।তবে হাতদ্বয়ের বৃষ্টিস্নান দীর্ঘস্থায়ী হল না।দরজায় কড়া পরার শব্দে থমকে যায় তিথি। -কে? -আমি। -ও, বৃন্তদা !এসো। -বসার ঘরে অনেক্ষন বসেছিলাম তোর জন্য।আসছিস না দেখে চলে যাচ্ছিলাম।কাকিমা পাঠিয়ে দিল তোর ঘরে। -বেশ তো, বোসো। অদ্ভত মানুষ এই বৃন্তদা।চালচুলো বলতে কিছু নেই নিজের।অথচ দেখো দানের দিকে তার জুড়ি মেলা ভার। সূর্যপুত্র কর্ণও বুঝি মাথা ঝুঁকোবেন তার দানশীলতা দেখে।হঠাৎ হঠাৎ করেই উদয় হয় এই বৃন্তদা।আবার কোথায় যেন চলে যায়।কি যেন কোন পত্রিকার অফিসে লেখালেখি করে দু পয়সা রোজগার করতো।চাকরিটা আছে নাকি গেছে কে বলতে পারে!
ক্ষনিক নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করল তিথি। -এতদিন কোথায় ছিলে? -একবারটি দেশে গিয়েছিলাম। -সেটা কোথায়?কখনো বল নি তো। -চিনবি না।তাই বলি নি।
কথা বাড়ালো না তিথি। নিস্তব্ধতা আবারো গ্রাস করে ফেলল অন্ধকার ঘরটার প্রত্যেকটি শিরা উপশিরাকে।বাইরের বৃষ্টি এবার প্রবল রুপে আছড়ে পড়তে শুরু করল।তিথি আবারো হাত না ভিজিয়ে থাকতে পারলো না। বৃন্তদা না থাকলে হয়ত সে একটু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।মানুষটা যে অসাধারণ সে বিষয় প্রমান করে তার ব্যবহার। তবে অসাধারণ হলেও তাকে পছন্দ করে না তিথি।পছন্দ হবার মতো মানুষও সে না। চুল দাড়ি সম্পর্কে সে উদাসিন। যতদিন দেখা হয়েছে কেবল একটি পোশাকই জড়ানো ছিল তার শরীরে। এককথায় সে একটা নোংরা। নেহাৎই তিথির মা তাকে ছেলের মতো ভালবাসে, নাহলে তিথি কখনো মিশতও না ওর সাথে। বৃন্তদা জিজ্ঞাসা করলো, -অন্ধকারে একা একা কি করছিলি এতক্ষণ ?প্রদীপ জ্বালিস নি কেন? -অপেক্ষা। -কার? -অতিথি। -তিথির অতিথি?বেশ মানিয়েছে তো। বৃন্তদার পরবর্তী প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই তিথি বলতে থাকে ক্ষীণস্বরে, ঐ যে আকাশটা দেখতে পাচ্ছো ? আর ঐ যে মেঘগুলো ?আর ঐ যে মেঘের আড়ালে ঢেকে যাওয়া চাঁদের জ্যোৎস্না ? ওখানে সে আসে । প্রতিরাতে সে আসে। গুটি গুটি ডানা মেলে কালো আকাশের বুকে, জ্যোৎস্না দিয়ে সুতো বানায়,সেগুলো জোড়া লাগায়, মেঘ দিয়ে মালা বানায়, তারপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় আমার কাছে।আমি দু হাত দিয়া তা লুফে নেই।
-বটে।মাথাটা তোর গেছে,বুঝলি? -না গো।সে আসবে আজো।তোমাকে দেখাবো।জানো তো তার ডানা দুটো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে যেন কিছু বলতে চায়। অদ্ভুত রকম স্বচ্ছ সে ডানা।আমি নিজেকে দেখতে পাই সেই ডানায়। চাঁদের আলো সে ডানায় আছড়ে পড়তে থাকে। নীরব তার ভাষা, কিন্তু মন ছুঁয়ে যায়। এমনভাবে ফিরে দাঁড়ায় যেন........................................................... । -যেন? -না থাক।কিছু না। -বলিস কিরে?সে কি উড়তে পারে নাকি? -পারে বৈকি! আমি দেখেছি তাকে উড়তে। -ভুত নয় তো? প্রেতাত্মা? -হলে হবে।
-হে ভালবাসা, তুমি কি গিরি নিঃস্রাব ঝর্না? নাকি অলিক কোন ধারণা ? তুমি কি মেঘ কালো করা আকাশ চুম্মন? নাকি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজানো কম্পন? লুণ্ঠিত হৃদয় কুণ্ঠিত চিত্তে কেবলই জানিতে চায়, সখী ভালবাসা কারে কয়? -তুমি কেবলই ঠাট্টা করো বৃন্তদা। এই ভালাবাসার অর্থ তুমি কিভাবে বুঝবে?ভালবাসার সুযোগ কখনো পেয়েছো নাকি? ভালবাসা পাবার মতো একুলে তোমার কেই বা আছে?
কথাটা বলে দ্বিধায় ভোগে তিথি। কষ্ট পায় নি তো বৃন্তদা? প্রকৃতির নিস্তব্ধতা নামক উপমাটি হঠাৎ করেই গাঁঢ়তা পেয়ে গেলো। বৃন্তদা বুঝতে পারলো তিথি অনিচ্ছাকৃতভাবে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। তাই গলাটা স্বাভাবিক করে বলল, -হ্যাঁ রে তিথি, তোর অতিথি কি তোকে ভালবাসে? -হয়ত বা। -বলেছে তোকে? -না। -তবে? -তার নীরবতা বলেছে আমাকে কানে কানে।ভালবাসে বলেই সে প্রতি রাতে আসে।ডানা মেলে উড়তে থাকে। পূর্ণিমারাতে তার ছায়া এসে পড়ে আমার গায়ে।প্রতি রাতে আমি খেলি ঐ ছায়াটির সাথে। কতটা পবিত্র ওর কাছে আসা! কতটা নিখুঁত ওর সঙ্গদান! এর মাঝে কোন প্রত্যাশা নেই।কন স্বপ্নও নেই। কেবলই বর্তমানের হাতে বানান রাস্তায় পা চালানো।
নীরব এক ভ্রান্ত ভালবাসাকে নিজের অজান্তেই বড্ড ভালবেসে ফেলেছে তিথি এই কয়দিনের মধ্যে । বৃন্তদা অবাক হয়ে যায়।কোনো এক অপ্রাক্রিতিক শক্তি তিথির হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলেছে।হেসে ওঠে বৃন্তদা। -বড্ড ছেলেমানুষ তুই।এ তোর মনের ভুল। -না গো। দেখো,ও আসবে।আজও আসবে। ঘড়ির কাঁটাদের সাথে পাল্লা দিয়া বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল।কোন ছায়া এসে পরলো না তিথির গায়ে।কেউ মেঘ ছুঁড়েও মারলো না। এক জোড়া ডানারও দেখা মিললো না আকাশের বুকে। এতক্ষনে অন্ধকার সয়ে এসেছে দুজনেরই চোখে। বৃন্তদা তাকিয়ে দেখলো তিথির চোখ জোড়া ছল ছল করছে। ইচ্ছে হলো হাত দিয়ে চোখ দুটো মুছে দিতে। নাহ, সাহস হলো না শেষ পর্যন্ত। বৃন্ত দা উঠে পড়লো । -কি হলো! উঠলে যে! -আজ বোধোয় তোর অতিথি আসবে না। -না গো ,আমি ঠিক জানি ও আসবে।দেখে নিও। -হয়ত আসবে।কিন্তু আমি এখানে থাকলে না।
তিথির কাঁদো কাঁদো কণ্ঠস্বরে পরের কথাটা শোনার অপেক্ষা করলো না বৃন্তদা,পা চালালো দ্রুত।তিথি আর বাঁধা দিলো না। বৃন্তদার কথাটা মেনে নিলো।হয়তো বৃন্তদা আছে বলেই এখনো আকাশের বুকে ডানা জোড়া কেউ মেলে নি।দরজা পেরোবার মুহূর্তে পিছে ফিরলো বৃন্তদা।তিথির দৃষ্টি আকাশের দিকে। হাসলো বৃন্তদা । তারপর আবার ত্বরণ বৃদ্ধি করলো তার পা জোড়ায়।তাকে যে যতটা দ্রুত সম্ভব যেতে হবে।আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে।প্রতিদিনের মতো আজকেও তাকে বাতাসে ডানা মেলতে হবে, গোটা আকাশ জুড়ে উড়তে হবে,মেঘদের মালা বানাতে হবে, অনেক কাজ। বাইরের প্রচন্ড বৃষ্টিতে তার পাতলা ডানা ভিজে যায় যাক,তবুও চোখের জলে যেন মেয়েটার অধরদ্বয় না ভেজে। [অজানা লেখকের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত]
বাইরের প্রচন্ড বৃষ্টিতে তার পাতলা ডানা ভিজে যায় যাক,তবুও চোখের জলে যেন মেয়েটার অধরদ্বয় না ভেজে।
উত্তরমুছুন