কৃষ্ণাভ - জয়ন্ত
মায়ের সাথে কথা বলিনা অনেকদিন হল।তার সামনেও যাই না।একটা তীব্র রাগ জন্ম নিয়েছিলো আমার তার প্রতি।আর সেই রাগ থেকেই হয়তোবা ঘৃণা এসেছিলো আমার মধ্যে। একটা সময় মনে হতে লাগলো,আমার জন্মের জন্য যেমন আমার মা দায়ী,তেমনি আমার জীবিত অবস্থায় মৃত্যুর জন্যও সে-ই একমাত্র দায়ী।তার ছবিটাও আমি এক ফাঁকে আমার রুম থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম।তার ছায়া মাড়াতেও আমার দ্বিধা হতে লাগলো সে সময়।
আমার মা মারা গেছে বছর চারেক হল। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা প্যারালাইজড হয়ে গেলো। শুধু হাত পা আর শরীরই নয়, তিনি বাকশক্তিও এক পর্যায়ে হারিয়ে ফেললেন।মায়ের মৃত্যুর পর তার এ অবস্থার কারণে সবাই ভাবতে লাগলো মায়ের মৃত্যুশোকে তার এই দশা। কিন্তু আমার মনে হল বাবাই মাকে মেরে ফেলেছেন। তিল তিল করে তিনিই মায়ের ভেতরে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা পুষ করেছেন। আমার মা আত্মহত্যা করেছিলো গলায় দড়ি দিয়ে। তার গলার দড়ি থেকে একটা কান্নার সুর ভেসে আসতে শুনেছিলাম আমি, আর শুনতে পাচ্ছিলাম বাবার বাজখাঈ গলায় মায়ের প্রতি তাচ্ছিল্যের সুর। মায়ের শরীর যখন ধোয়া হচ্ছিলো, তখন কানাঘুষোয় বুঝতে পেরেছিলাম পর্দার ওপারের মেয়েরা মায়ের শরীরের স্থানে স্থানে কাঁটা দাগ দেখে আঁতকে উঠছিল। আমার সেসবে অভ্যাস আছে,তাই আমি অবাক হই নি। মায়ের মারা যাবার পর আমি বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখি নি। আবার কখনো তাকে কথা বলতেও দেখি নি। হয়ত তিনি এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলেন যে, অত্যাচার করার মতো তিনি আর কাউকে পাবেন না।
পরিবারের যখন এই সংকটাবস্থা,তখন সবে মাত্র আমি ইউনিভার্সিটিতে উঠেছি। পেটের কথা চিন্তা করে পড়াশুনা ছাড়লাম। আমার বাবার একটা বইয়ের ছোট্টো দোকান ছিল, সেটারই দেখভাল করবো ভাবলাম। সারাদিন বইয়ের দোকানে বসে বসে নানা রকম বই পড়ার অভ্যাসটা গড়ে তুললাম। বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো। তবে এমন সুখের দিনের ভ্রম আমার বেশী দিন থাকল না। একদিন রাতে দোকান থেকে বাড়ী ফিরে দেখি একজন মধ্যবয়স্কা একটা ঘূণে ধরা চেয়ারে বসে আছেন। তার থেকে একটু দূরে বাবা হুইল চেয়ারে, বাবার চোখ দুটো ডাইনিং টেবিলে রাখা একটা মিষ্টির প্যাকেটের দিকে নিবদ্ধ।বুঝলাম বাবার মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি আমার বাবার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ভদ্রমহিলার পরিচয় এবং আসবার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে একটা চিঠি দিলেন এবং শব্দ করে পড়তে বললেন যাতে আমার বাবাও শুনতে পারেন।
চিঠিটা বেশ বড় ছিল, তবুও অনাগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। চিঠিটা আমার মৃত মায়ের লেখা, তার কোনও এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে। কিছুক্ষণ পর এটুকু বুঝতে আর বাকি থাকল না যে সেই বান্ধবী আর কেউ নয়, আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি। চিঠিটার সারমর্ম এই ছিল যে,আমার মা তার বান্ধবীকে কথা দিয়েছিল তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবেন। হয়তবা এ চিঠিটা আমার মা তার কৈশোরকালে খেলাচ্ছলে তার বান্ধবীকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সুযোগ সন্ধানি সখী এতটা দিন পর ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন।মায়ের চিঠিটা পড়া শেষ হলে বাবার দিকে তাকালাম আমি। বাবাকে দেখলাম গোলগোল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কোনো ভুমিকা না করে সরাসরি বলে না বলে দিলাম। বাবাও তার বিচ্ছিরি দৃষ্টি সংযত করে মাথা ঘুরিয়ে আবার মিষ্টির প্যাকাটের দিকে তাকালেন।
সেদিন মুখের উপর না বলেছিলাম বটে, কিন্তু সময়ান্তে ঠিকই আমার বিয়েটা হয়ে গেল, এবং ঠিক করে ঐ মেয়েটার সাথেই। কোনদিনই মায়ের অবাধ্য হই নি। ভাবলাম, শেষবারের মত তার কথা রাখতে সমস্যা কি! কিন্তু মায়ের প্রতি বাধ্যতা যে কালান্তে মায়ের প্রতি ঘৃণার জন্ম দেবে তা আগে জানলে বিয়েটা করতাম না। মেয়েটার ছবিও আমি দেখিনি, বিয়ের আগেও না এবং পরেও না। আগে দেখার প্রয়োজনবোধ করি নি। আর বিয়ের পর যেদিন জানতে পারলাম মেয়েটা বোবা, সেদিন থেকে ওর মুখ দেখার আর ইচ্ছে করে নি। একবার ভাবলাম ডিভোর্স দেবো মেয়েটাকে। কিন্তু বাবার মিষ্টির প্যাকাটের দিকে তাকিয়ে থাকা নিস্পলক নির্লজ্জ চোখ দুটোর কথা মনে পড়লে আর কিছু করার ইচ্ছে জাগে না।
মেয়েটার নাম ছিল আনন্দ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের আনন্দের মতোই সে-ও চন্দ্রালোক নিয়ে খেলত, পূর্ণিমার রাতে সে বাড়ির ছাদে গিয়ে নাচত। বেশ কয়েকদিন শব্দ পেয়ে আমি ছাদে উঠে লুকিয়ে লুকিয়ে তার নাচ দেখেছি। প্রত্যেকটা মানুষেরই দুঃখ প্রকাশের কোনও একটা মাধ্যম আছে। কেউ কবিতা লেখে, কেউ গান গায়। সেদিন প্রথমবারের মত আমি কারো নাচ দেখে কেঁদেছিলাম। কিন্তু সেগুলো আমার কাছে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছুই লাগতো না।হয়ত সেটার পেছনে একমাত্র কারণ হতে পারে- সে বোবা। সে তার আদিখ্যেতা আর ন্যাকামি দ্বারা আমার বাবার মন জয় করে ফেলেছিল।কিন্তু আমার কাছে তিরস্কার পেয়ে সে কাছে ঘেঁষতেও ভয় পেতে লাগল ।আমি ভাবতাম - বেঁচে গেছি।
বেশ কদিন পর আমার ধুমছে জ্বর আসলো। জ্বরের ঘোরে এই প্রথম বার আমি আনন্দের মুখের দিকে তাকালাম। চোখে কোন কাজল ছিল না, সেখানে কেবল ছিল নিদ্রাহীনতার ছাপ।বুঝতে আর বাকি রইল না যে সবটা সময় সে আমার পাশে বসেই আমার সেবা করে গেছে। দেখলাম তার ঘাড়ের উপর দিয়ে চুল গুলো তার বুক ছাপিয়ে চলে গেছে।মনে হতে লাগলো অন্ধকারে কোনো পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে চলেছে বরফ শীতল কালো জল।এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম আমি, ভুলে গেলাম এতটা সুন্দর কৃষ্ণাভ চুলের অধিকারিণী একজন বোবা। সেই মুহূর্তেই হয়তবা জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মত কোনও নারীর প্রেমে পড়লাম, কোনো নারী দেহের প্রেমে পড়লাম। জ্বরের মধ্যেও আমি আনন্দের শরীরের মাংসের ঘ্রান পাচ্ছিলাম স্পষ্টভাবে।
কিছুদিন যাবত হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলাম। আমার মা আমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল,
- বলো তো, আমি তোমায় আমার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই কেন?
আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম,
- যাতে আমি আমার বাবার মতন না হই।
সে কথা সুনে মা হাসতে হাসতে প্রায় মূর্ছা যায়। অনেক কষ্টে হাসি সঞবরন করে বললেন,
- তুমি তোমার বাবার মতন হও কিবা না হও অথবা তোমার জীবন তোমার বাবার মতন হক বা না হোক তাতে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। আমি তোমায় আমার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই এই কারনে যে, তোমার স্ত্রীর জীবনটা যেন তোমার মায়ের মতন না হয়।
জ্বরের থেকে ওঠার পর আনন্দের কাছে যাবার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলো। এড়ানোর কারণটা ভয় নাকি ঘৃণা , তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। একদিন সখ করে একটা কথা বলা শালিক এনেছিলাম একটা বাঁশের খাঁচায় ভরে। শালিকটা নিজ হাতে আমি আনন্দকে দিলাম।পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঝুলবারান্দায় গিয়ে দেখি শালিকের খাঁচাটি ফাকা পড়ে আছে।বুঝলাম এই নারীর চিন্তাশক্তিকে আমার দুর্বল চিন্তাশক্তি দ্বারা চিন্তা করে বিশ্লেষণ করা আমার মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার আদিখ্যেতায় যেন মিশে আছে একটা মর্মান্তিক মমতা, যার মানুষ বশীভূত করবার এক আশ্চর্য প্রতিভা আছে। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে হাহাকার দিয়ে উঠলো।এ আমি কার সাথে বাস করছি! যার কাছে কথা বলা শালিক অপেক্ষা নির্বাক খাঁচা অধিক দৃষ্টিনন্দিত, তার দিকে এতটাকাল আমি ভ্রূক্ষেপ করি নি! নিজের মূর্খতাকে ভৎসনা করতে লাগলাম।
কিছুদিন যাবত আমার বইয়ের তাকের বইগুলকে বড্ড এলোমেলো লাগতে লাগলো। গল্পগুচ্ছটাকে রেখেছিলাম সবচেয়ে উপরের তাকের বাম কোণায়। সেদিন দেখলাম সেটা হুমায়ুনের উপন্যাস গুলোর মাঝখান থেকে উঁকি মারছে। বুঝতে পারলাম আনন্দের বই পড়ার নেশা আছে। দিনকে দিন আমি দোকান থেকে বই আনতে আনতে বুক সেলফটা ভরিয়ে তুললাম। মনে মনে ভাবলাম, আনন্দের মন পাবার জন্য কথা বলা শালিক অপেক্ষা বোবা বই ঢের ভাল। আনন্দকে দেখে অনেকটা ধাতস্ত মনে হল। একসময় দেখলাম সে আমার খাবার সময় আর আগের মত দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে থাকে না, ভেতরে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। আমি তাকাতে পারতাম না ওর দিকে, কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা আত্মগ্লানিতে।
আত্মগ্লানি বৃদ্ধি পেল সেদিন যেদিন আনন্দ মারা গেল। আনন্দ মারা গেল সেই উপন্যাসের নায়িকার মতই, নাচতে নাচতে। সেদিন রাতে আমি বাড়ীতেই ছিলাম। চাঁদের আলোয় চারিদিকে যেন আনন্দের কল্লোল বইছিল। আনন্দও গা ভাসিয়েছিল তাতে।সে চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে কখন যেন ছাদে চলে গেল। আমি অন্ধকার ঘরে চাঁদের হালকা আলোতে দেখতে পেলাম কৃষ্ণাভ কোনো দেবী চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছে।ধীরে ধীরে পিছু নিলাম তার। আনন্দকে দেখে মনে হলো সে যেন কোনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। চন্দ্রালোকে তার নাচ আগেও অনেকবার দেখেছি। কিন্তু সেদিনকার নাচটা ছিল ধ্বংসাত্মক। ধ্বংসটা কিসের তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সেটা কি আমার নির্লজ্জ প্রেমের নাকি আনন্দের নির্লিপ্ত ভালবাসার!
আনন্দ আমার চোখের সামনেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিল।আমি হতভম্বের মত দাড়িয়ে ছিলাম। কয়েকবার আস্তে আস্তে ওর নাম ধরে ডাক দিলাম। কোনও সাড়া আসলো না।ছাদের উপর থেকে চাঁদের আলোতে দেখতে পেলাম আনন্দের নিথর দেহের মুখ চিরে হাসির ফেনা বার হচ্ছে। বুঝতে পারলাম শালিক খাঁচায় আটকে রেখে কত বড় ভুল করে ফেলেছি। একটা সুক্ষ হাসিতে ফেটে পড়লাম আমি। রাগ হল খুব আনন্দের উপর। মায়ের শিক্ষাটার মূল্য দেবার সুযোগ দিল না সে আমায়!
আমার মা মারা গেছে বছর চারেক হল। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা প্যারালাইজড হয়ে গেলো। শুধু হাত পা আর শরীরই নয়, তিনি বাকশক্তিও এক পর্যায়ে হারিয়ে ফেললেন।মায়ের মৃত্যুর পর তার এ অবস্থার কারণে সবাই ভাবতে লাগলো মায়ের মৃত্যুশোকে তার এই দশা। কিন্তু আমার মনে হল বাবাই মাকে মেরে ফেলেছেন। তিল তিল করে তিনিই মায়ের ভেতরে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা পুষ করেছেন। আমার মা আত্মহত্যা করেছিলো গলায় দড়ি দিয়ে। তার গলার দড়ি থেকে একটা কান্নার সুর ভেসে আসতে শুনেছিলাম আমি, আর শুনতে পাচ্ছিলাম বাবার বাজখাঈ গলায় মায়ের প্রতি তাচ্ছিল্যের সুর। মায়ের শরীর যখন ধোয়া হচ্ছিলো, তখন কানাঘুষোয় বুঝতে পেরেছিলাম পর্দার ওপারের মেয়েরা মায়ের শরীরের স্থানে স্থানে কাঁটা দাগ দেখে আঁতকে উঠছিল। আমার সেসবে অভ্যাস আছে,তাই আমি অবাক হই নি। মায়ের মারা যাবার পর আমি বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখি নি। আবার কখনো তাকে কথা বলতেও দেখি নি। হয়ত তিনি এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলেন যে, অত্যাচার করার মতো তিনি আর কাউকে পাবেন না।
পরিবারের যখন এই সংকটাবস্থা,তখন সবে মাত্র আমি ইউনিভার্সিটিতে উঠেছি। পেটের কথা চিন্তা করে পড়াশুনা ছাড়লাম। আমার বাবার একটা বইয়ের ছোট্টো দোকান ছিল, সেটারই দেখভাল করবো ভাবলাম। সারাদিন বইয়ের দোকানে বসে বসে নানা রকম বই পড়ার অভ্যাসটা গড়ে তুললাম। বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো। তবে এমন সুখের দিনের ভ্রম আমার বেশী দিন থাকল না। একদিন রাতে দোকান থেকে বাড়ী ফিরে দেখি একজন মধ্যবয়স্কা একটা ঘূণে ধরা চেয়ারে বসে আছেন। তার থেকে একটু দূরে বাবা হুইল চেয়ারে, বাবার চোখ দুটো ডাইনিং টেবিলে রাখা একটা মিষ্টির প্যাকেটের দিকে নিবদ্ধ।বুঝলাম বাবার মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি আমার বাবার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ভদ্রমহিলার পরিচয় এবং আসবার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে একটা চিঠি দিলেন এবং শব্দ করে পড়তে বললেন যাতে আমার বাবাও শুনতে পারেন।
চিঠিটা বেশ বড় ছিল, তবুও অনাগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। চিঠিটা আমার মৃত মায়ের লেখা, তার কোনও এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে। কিছুক্ষণ পর এটুকু বুঝতে আর বাকি থাকল না যে সেই বান্ধবী আর কেউ নয়, আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি। চিঠিটার সারমর্ম এই ছিল যে,আমার মা তার বান্ধবীকে কথা দিয়েছিল তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবেন। হয়তবা এ চিঠিটা আমার মা তার কৈশোরকালে খেলাচ্ছলে তার বান্ধবীকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সুযোগ সন্ধানি সখী এতটা দিন পর ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন।মায়ের চিঠিটা পড়া শেষ হলে বাবার দিকে তাকালাম আমি। বাবাকে দেখলাম গোলগোল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কোনো ভুমিকা না করে সরাসরি বলে না বলে দিলাম। বাবাও তার বিচ্ছিরি দৃষ্টি সংযত করে মাথা ঘুরিয়ে আবার মিষ্টির প্যাকাটের দিকে তাকালেন।
সেদিন মুখের উপর না বলেছিলাম বটে, কিন্তু সময়ান্তে ঠিকই আমার বিয়েটা হয়ে গেল, এবং ঠিক করে ঐ মেয়েটার সাথেই। কোনদিনই মায়ের অবাধ্য হই নি। ভাবলাম, শেষবারের মত তার কথা রাখতে সমস্যা কি! কিন্তু মায়ের প্রতি বাধ্যতা যে কালান্তে মায়ের প্রতি ঘৃণার জন্ম দেবে তা আগে জানলে বিয়েটা করতাম না। মেয়েটার ছবিও আমি দেখিনি, বিয়ের আগেও না এবং পরেও না। আগে দেখার প্রয়োজনবোধ করি নি। আর বিয়ের পর যেদিন জানতে পারলাম মেয়েটা বোবা, সেদিন থেকে ওর মুখ দেখার আর ইচ্ছে করে নি। একবার ভাবলাম ডিভোর্স দেবো মেয়েটাকে। কিন্তু বাবার মিষ্টির প্যাকাটের দিকে তাকিয়ে থাকা নিস্পলক নির্লজ্জ চোখ দুটোর কথা মনে পড়লে আর কিছু করার ইচ্ছে জাগে না।
মেয়েটার নাম ছিল আনন্দ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের আনন্দের মতোই সে-ও চন্দ্রালোক নিয়ে খেলত, পূর্ণিমার রাতে সে বাড়ির ছাদে গিয়ে নাচত। বেশ কয়েকদিন শব্দ পেয়ে আমি ছাদে উঠে লুকিয়ে লুকিয়ে তার নাচ দেখেছি। প্রত্যেকটা মানুষেরই দুঃখ প্রকাশের কোনও একটা মাধ্যম আছে। কেউ কবিতা লেখে, কেউ গান গায়। সেদিন প্রথমবারের মত আমি কারো নাচ দেখে কেঁদেছিলাম। কিন্তু সেগুলো আমার কাছে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছুই লাগতো না।হয়ত সেটার পেছনে একমাত্র কারণ হতে পারে- সে বোবা। সে তার আদিখ্যেতা আর ন্যাকামি দ্বারা আমার বাবার মন জয় করে ফেলেছিল।কিন্তু আমার কাছে তিরস্কার পেয়ে সে কাছে ঘেঁষতেও ভয় পেতে লাগল ।আমি ভাবতাম - বেঁচে গেছি।
বেশ কদিন পর আমার ধুমছে জ্বর আসলো। জ্বরের ঘোরে এই প্রথম বার আমি আনন্দের মুখের দিকে তাকালাম। চোখে কোন কাজল ছিল না, সেখানে কেবল ছিল নিদ্রাহীনতার ছাপ।বুঝতে আর বাকি রইল না যে সবটা সময় সে আমার পাশে বসেই আমার সেবা করে গেছে। দেখলাম তার ঘাড়ের উপর দিয়ে চুল গুলো তার বুক ছাপিয়ে চলে গেছে।মনে হতে লাগলো অন্ধকারে কোনো পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে চলেছে বরফ শীতল কালো জল।এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম আমি, ভুলে গেলাম এতটা সুন্দর কৃষ্ণাভ চুলের অধিকারিণী একজন বোবা। সেই মুহূর্তেই হয়তবা জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মত কোনও নারীর প্রেমে পড়লাম, কোনো নারী দেহের প্রেমে পড়লাম। জ্বরের মধ্যেও আমি আনন্দের শরীরের মাংসের ঘ্রান পাচ্ছিলাম স্পষ্টভাবে।
কিছুদিন যাবত হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলাম। আমার মা আমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল,
- বলো তো, আমি তোমায় আমার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই কেন?
আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম,
- যাতে আমি আমার বাবার মতন না হই।
সে কথা সুনে মা হাসতে হাসতে প্রায় মূর্ছা যায়। অনেক কষ্টে হাসি সঞবরন করে বললেন,
- তুমি তোমার বাবার মতন হও কিবা না হও অথবা তোমার জীবন তোমার বাবার মতন হক বা না হোক তাতে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। আমি তোমায় আমার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই এই কারনে যে, তোমার স্ত্রীর জীবনটা যেন তোমার মায়ের মতন না হয়।
জ্বরের থেকে ওঠার পর আনন্দের কাছে যাবার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলো। এড়ানোর কারণটা ভয় নাকি ঘৃণা , তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। একদিন সখ করে একটা কথা বলা শালিক এনেছিলাম একটা বাঁশের খাঁচায় ভরে। শালিকটা নিজ হাতে আমি আনন্দকে দিলাম।পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঝুলবারান্দায় গিয়ে দেখি শালিকের খাঁচাটি ফাকা পড়ে আছে।বুঝলাম এই নারীর চিন্তাশক্তিকে আমার দুর্বল চিন্তাশক্তি দ্বারা চিন্তা করে বিশ্লেষণ করা আমার মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার আদিখ্যেতায় যেন মিশে আছে একটা মর্মান্তিক মমতা, যার মানুষ বশীভূত করবার এক আশ্চর্য প্রতিভা আছে। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে হাহাকার দিয়ে উঠলো।এ আমি কার সাথে বাস করছি! যার কাছে কথা বলা শালিক অপেক্ষা নির্বাক খাঁচা অধিক দৃষ্টিনন্দিত, তার দিকে এতটাকাল আমি ভ্রূক্ষেপ করি নি! নিজের মূর্খতাকে ভৎসনা করতে লাগলাম।
কিছুদিন যাবত আমার বইয়ের তাকের বইগুলকে বড্ড এলোমেলো লাগতে লাগলো। গল্পগুচ্ছটাকে রেখেছিলাম সবচেয়ে উপরের তাকের বাম কোণায়। সেদিন দেখলাম সেটা হুমায়ুনের উপন্যাস গুলোর মাঝখান থেকে উঁকি মারছে। বুঝতে পারলাম আনন্দের বই পড়ার নেশা আছে। দিনকে দিন আমি দোকান থেকে বই আনতে আনতে বুক সেলফটা ভরিয়ে তুললাম। মনে মনে ভাবলাম, আনন্দের মন পাবার জন্য কথা বলা শালিক অপেক্ষা বোবা বই ঢের ভাল। আনন্দকে দেখে অনেকটা ধাতস্ত মনে হল। একসময় দেখলাম সে আমার খাবার সময় আর আগের মত দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে থাকে না, ভেতরে এসে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। আমি তাকাতে পারতাম না ওর দিকে, কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা আত্মগ্লানিতে।
আত্মগ্লানি বৃদ্ধি পেল সেদিন যেদিন আনন্দ মারা গেল। আনন্দ মারা গেল সেই উপন্যাসের নায়িকার মতই, নাচতে নাচতে। সেদিন রাতে আমি বাড়ীতেই ছিলাম। চাঁদের আলোয় চারিদিকে যেন আনন্দের কল্লোল বইছিল। আনন্দও গা ভাসিয়েছিল তাতে।সে চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে কখন যেন ছাদে চলে গেল। আমি অন্ধকার ঘরে চাঁদের হালকা আলোতে দেখতে পেলাম কৃষ্ণাভ কোনো দেবী চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছে।ধীরে ধীরে পিছু নিলাম তার। আনন্দকে দেখে মনে হলো সে যেন কোনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। চন্দ্রালোকে তার নাচ আগেও অনেকবার দেখেছি। কিন্তু সেদিনকার নাচটা ছিল ধ্বংসাত্মক। ধ্বংসটা কিসের তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সেটা কি আমার নির্লজ্জ প্রেমের নাকি আনন্দের নির্লিপ্ত ভালবাসার!
আনন্দ আমার চোখের সামনেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিল।আমি হতভম্বের মত দাড়িয়ে ছিলাম। কয়েকবার আস্তে আস্তে ওর নাম ধরে ডাক দিলাম। কোনও সাড়া আসলো না।ছাদের উপর থেকে চাঁদের আলোতে দেখতে পেলাম আনন্দের নিথর দেহের মুখ চিরে হাসির ফেনা বার হচ্ছে। বুঝতে পারলাম শালিক খাঁচায় আটকে রেখে কত বড় ভুল করে ফেলেছি। একটা সুক্ষ হাসিতে ফেটে পড়লাম আমি। রাগ হল খুব আনন্দের উপর। মায়ের শিক্ষাটার মূল্য দেবার সুযোগ দিল না সে আমায়!
এত তারাতারি শেষ ???
উত্তরমুছুনশেষ তো হতেই হত একটাসময়। নাহলে তো ওটা আর ছোটগল্প থাকতো না, জীবন হয়ে উঠত। দুঃখিত আশানুরূপ না হওয়ার জন্য
মুছুনঅপ্রাপ্তি রহিয়া গেল লেখক!
উত্তরমুছুনঅপ্রাপ্তিই মাঝে মাঝে অনেক কিছু পাইয়ে দেয়।কেউ পায় কেউ পায় না।সবাইকে না পাওয়ানোটা লেখকের ব্যর্থতা। দুঃখিত
মুছুনগল্পটার নাম অপ্রাপ্তি হলে কেমন হত? কারোরই কিছু প্রাপ্ত হল না। না আমার, না আনন্দের, না আপনার।
মুছুন