রঙ পেন্সিল - জয়ন্ত
বাবুনের মা মারা গেছেন বছর ছয়েক হল, বাবুনের যখন দু বছর বয়েস তখন।এখন বাবুন আট বছরে পৌঁছে গেছে।তার মায়ের কোন স্মৃতিই তার মনে পড়ে না। মায়ের কোলে বসে গান শোনা, চাঁদমামা দেখা, ঘুমিয়ে যাওয়া- এসব কোন কিছুই তার মনে নেই। মাঝে মাঝে মায়ের কথা একটু বেশি মনে পড়লে এ্যালবাম ঘেঁটে দু চারটা ছবি দেখা ছাড়া আর উপায় নেই তার।
বাবুনের বাবা কাজ করে কর অফিসে। সে সামান্য একজন পিয়ন মাত্র। সারাদিন খাটাখাটনির পর রাতে যখন বাবুনকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেন তিনি, তখন তিনি যেন ভুলে যান তার সারাদিনের ক্লান্তি। মায়ের অভাব ভোলানোর জন্য তার চেষ্টার কোন কমতি যদিও নেই, তবুও সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টিগুলোর মধ্যে একটা হল মাতৃস্নেহ, একজন শিশুর কাছে যার কোন বিকল্প নেই। দ্বিতীয় বিবাহের কথা অবশ্য অনেকে তাকে পরামর্শ হিসেবে বলেছেন, কিন্তু তিনি সেসব প্রস্তাব সব একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছেন।
বাবুনের বাবা মাঝে মাঝেই বাবুনকে আকাশের গল্প শোনান, সেই সাথে চলে তারা হওয়ার গল্পও। মানুষ মরে গেলে যে তারা হয়ে যায় সেই তারার গল্প।
-ঐ যে তারাটা দেখছ, সব থেকে বেশি জ্বলজ্বল করছে?
-হ্যাঁ।
-ঐটা হলেন তোমার মা।
-আচ্ছা বাবা
-বল।
-মা হঠাৎ তারা হতে গেলেন কেন?
-তারা হলে তো আর কোন দুঃখ থাকে না। চারিদিকে শুধু আনন্দ আর হাসির বন্যা।
-তাহলে বাবা আমরাও কি একদিন তারা হবো?মায়ের কাছে যেতে পারব?
তার বাবা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
বাবার কথা শুনে বেশ আশ্বস্ত হয় বাবুন- যাক তার মা তো তারা হয়ে বেশ আছে। তারা হওয়ার গল্প শুনতে শুনতে বাবুনেরও তারা হওয়ার সাধ জাগে খুব।কিন্তু সে তার বাবাকে ছেড়ে কখনই একা একা তারা হবে না। সে খুব ভালবাসে কিনা তার বাবাকে। এরকমই আরও অনেক শর্ত কল্পনা করতে থাকে সে মনে মনে। যেমন যদি তার বাবা কথা দেয় যে তার হলে তারা দুজনে মায়ের কাছে যেয়ে থাকবে
তবেই শুধুমাত্র সে তারা হতে রাজি হবে, নতুবা নয়।
বাবুনের বাবা যে মাসিক বেতন পান তাতে বাপ বেটার বেশ চলে যায়। বাবুনের বাবার ইচ্ছা বাবুনকে অনেক পড়াশুনা করাবেন। তিনি ছেলেকে যেনতেন স্কুলেও ভর্তি করলেন না। আবার পাছে ছেলে যেন খারাপ ছেলেদের সাথে না মিশতে পারে সেজন্য তিনি ছেলেকে নিয়ে তার অফিসের কাছাকাছি একটা আবাসিক এলাকায় দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটও ভাড়া নিয়ে নিলেন। খরচের দিকে তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তা করলেন না। কিন্তু তার হাঁটুর কাছের ফুটোটা ক্রমশই সকলের দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো।
বাবুনের বই পড়ার খুব শখ, এডভেঞ্চারের বই হলে তো আর কথাই নেই। এই বয়সেই সে চাঁদের পাহাড় শেষ করে ফেলেছে। নানান রকম সুপার হিউম্যানের কমিক্স বুক তো তার ঠোঁটের আগায় বলতে গেলে। সেসব পড়ার সময় সে নিজেকে সুপারবম্যান কিংবা স্পাইডারম্যান ভাবতেও দ্বিধাবোধ করে না। চাঁদের পাহাড় পড়বার সময় সে ভাবে সেই বুঝি শঙ্কর, সে-ই বুঝি হেঁটে চলেছে গহীন অরণ্যের পথ মাড়িয়ে। বাবুনের এসকল কল্পনা অবশ্য তার বাবার অগোচরে নয়। তার বাবা এসব কল্পনার কথা শোনেন আর হাসেন। অসম্ভব সুন্দর সে হাসি, বাবুন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে তা।
ইদানিং বাবুনের মনটা বেশ খারাপ। আগের বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় এসেছে সে বেশ ক মাস হল। কিন্তু নতুন কোনো বন্ধু হয় নি তার। সে অবশ্য চেয়েছিল বন্ধু হতে, সে চেয়েছিল এ পাড়ায় তার বয়সী যে ছেলে গুলো আছে, তাদের সাথে সেও একটা ফুটবল নিয়ে ঠিক বিকেল হলে মাঠ দাপিয়ে বেড়াবে। কিন্তু সে সুযোগ তার আর হল না, কেউ তাকে খেলতে নেয় নি। অগত্যা বারান্দার গ্রিল ধরে মাঠে তার সমবয়সী ছেলেগুলোর ফুটবল খেলা দেখা ছাড়া আর সময় কাটানোর সুযোগ থাকল না তার। ওরা যে তাকে খেলতে নেয় নি তার জন্য কিঞ্চিত দুঃখ পেয়েছে অবশ্য সে, কিন্তু তার মন খারাপের আসল কারণটা অন্য জায়গায়। তার কোনো ফুটবল নেই। তার যদি একটা ফুটবল থাকতো তবে সে একা একাই খেলতে পারত, কোনো বন্ধুর আর দরকার হত না তার। এসবই ভাবতে ভাবতে সে তার ড্রয়িং খাতায় একটা ফুটবলের ছবি আঁকলো।তার বাবা তাকে গতকাল একটা নতুন রঙ পেন্সিল বক্স কিনে দিয়েছে। খুবই যত্নে সেই রংপেঞ্ছিল গুলোই সে ব্যাবহার করেছে। বলা বাহুল্য বাবুন ছোটবেলা থেকেই বেশ ভালো ছবি আঁকে। সে কখনো ছবি আঁকা শেখে নি কারো কাছে, নিজের কল্পনা দিয়েই সে সর্বদা ছবি এঁকে এসেছে। বরাবরের মতন এ ছবিটাও বেশ সুন্দর হল। ছবিটা তার নিজের কাছেই বেশ পছন্দসই হয়েছে। যদি তার ঠিক এমনি একটা ফুটবল থাকত।ইস! ভাবতেই বিষণ্ণতা লাগে তার মনে। বারকয়েক ফুটবলটায় হাত বুলিয়ে খাতাটা বন্ধ করে আবারো বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা রাখল বাবুন। কি যেন একটা গোলাকার বস্তুতে ধাক্কা খেল তার পা। বাবুন তাকিয়ে দেখল সামনে। ওমা! একি! এসে সত্যিকারের একটা আস্ত ফুটবল। গভীর বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দু হাত দিয়ে বলটা তুলে নিল সে। বলটি দেখতে তার আগেরদিন আঁকা বলটার মতন অবিকল। বাবুন যেন কিছুতেই কিছু বিশ্বাস করতে পারছে না। এবার সে কি মনে করে বলটাকে কোলে নিয়ে দৌড় দিল তার টেবিলের কাছে। টেবিলের ঠিক উপরেই তার ড্রয়িং খাতাটা রাখা আছে।সে খাতাটা খুলে তার গতকালের আঁকা ফুটবলটার ছবি খুঁজতে লাগল।কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড! তার আঁকা সব কটি ছবিই সেখানে আছে কেবল মাত্র গতকালকের আঁকা সেই ফুটবলের ছবিটিই শুধু নেই। বাবুন কেমন জানি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই যেন সে বুঝতে পারছে না। তবে সে কি ম্যাজিক রঙ পেন্সিল পেয়েছে? তার বাবা তাকে যে রঙ পেন্সিল বক্সটা উপহার দিয়েছিল তাতে থাকা সব কটি পেন্সিলই কি তাহলে ম্যাজিক দিয়ে তৈরি?ম্যাজিক পেন্সিল বা কলমের গল্প অবশ্য সে আগে পড়েছে গল্পের বইয়ে।কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব! নিজের চোখ দুটোকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না বাবুন। তার বারবার মনে হচ্ছে সে যেন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ওদিকে তার আনন্দের বাঁধ ভেঙ্গে হাসির প্লাবন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়টাকে।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই তার পালা এল তার রঙ পেন্সিল গুলোর সত্যতা পরীক্ষা করার। সে সেই ড্রয়িং খাতা আর পেন্সিল গুলোকে নিয়ে বশে পড়ল আঁকতে। কিন্তু এবার সে কি আঁকবে! কিছুতেই যেন সে ভেবে পাচ্ছে না। কি মনে করে সে এবার একটা সুন্দর জামা একে ফেলল। পরদিন সকালে বাবুন বেশ আগ্রহ নিয়েই ঘুম থেকে উঠলো। প্রথম দিনের মতন আজকেও সে তার খাতায় আঁকা জিনিসটা দেখতে পেল তার বালিশের ঠিক পাশেই। একই সাথে তার খাতায় আঁকা ছবিটিও ভ্যানিশ। এবার বাবুনের মনে আর কোনও সংশয় রইল না। সে এবার নিস্তিত যে সে এই ম্যাজিক রঙ পেন্সিলের একাধিপত্য অধিকারী। তার আনন্দের সীমা যেন ক্রমশই ছারিয়ে যেতে লাগলো । আনন্দে নাচতে লাগলো সে। চিৎকার করে এ ঘর থেকে ওঘর ওঘর থেকে এঘর করতে লাগলো সে।
এমনি করে বাবুন প্রতিদিন স্কুল সেরে বাড়িতে ফিরেই আঁকার খাতা আর রঙ পেন্সিল নিয়ে বসে, আর তার পছন্দ মতন জিনিস আঁকিবুঁকি করে। আর তার সেই আঁকা ছবিগুলো সকাল হলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় হাওয়ায় এবং বাবুনের ঘুম ভাঙ্গার ঠিক আগ মুহূর্তে অলৌকিকভাবে বাস্তবরূপ নিয়ে ফিরে আসে বাবুনের কাছে। বাবুনের দিনগুলো এভাবে বেশ মজায় কাটতে লাগলো। কোনদিন সে রসগোল্লার ছবি আঁকে, কোনদিন বা চকলেট, কোনদিন আইসক্রিম, আবার কোন কোন দিন সে আঁকে তার পছন্দমত বিভিন্ন খেলনার ছবি। এমনি করে দিনকে দিন বাবুনের খেলনার বাক্সটা পূর্ণ হয়ে এল। বাবুনের এখন আর সঙ্গী না থাকার কষ্ট নেই। মন খারাপ ও আর তার হয় না সচারচর। এখন তার সব থেকে ভালো বন্ধু হল তার রঙ পেন্সিল।
একদিন হঠাৎ বাবা বাবুনকে বারান্দায় বসে কাঁদতে দেখলেন। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে জানতে চাইলেন তার কান্নার কারণ। প্রথমে তো বাবুন কিছুতেই তা বলবে না। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবুনের কান্নার কারণ আবিস্কার করলেন তার বাবা। বাবুনের সেই সাধের রংপেন্সিল বক্সের সব কটি পেন্সিলই প্রায় শেষ হবার পথে, যা অবশিষ্ট রয়েছে তা দিয়ে বড়জোর দুইটা কি একটা ছবি আঁকতে পারবে বাবুন। তারপর বাবুন কি করবে! আবার সে কি একা হয়ে পড়বে! আবার বন্ধুহীনতার কষ্ট তাকে গ্রাস করবে! বাবুনের বাবা যেন খানিকটা অবুঝের মতনই তার ছেলেকে আশ্বাস দিলেন আরেকটা নতুন রঙ পেন্সিল কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু বাবুনের কান্না তবুও থামে না। অবশেষে বেশ জোরাজোরিতে প্রকৃত ঘটনা বলল বাবুন। ওগুলো যে কোন সাধারণ রঙ পেন্সিল নয়, ম্যাজিক রঙ পেন্সিল - তা বলল বাবুন তার বাবাকে। তার বাবা মুখ টিপে হাসলেন খানিকটা। বললেন-তাহলে এক কাজ কর, ওই ম্যজিক রঙ পেন্সিলের বাকি অংশ টুকু দিয়েই নাহয় আরেকটি ম্যাজিক রংপেন্সিল বক্স এঁকে ফেলো, তবে তো তুমি নতুন ম্যাজিক রঙ পেন্সিল বক্স পেয়েই যাচ্ছ।
বুদ্ধিটা খুব ভালো লেগেছে বাবুনের।এবার সে কান্না থামিয়ে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। সেদিন রাতে খাবার পর বেশ কিছুক্ষন গল্পগুজব চলল বাপ বেটার মধ্যে। নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাবুনের মায়ের কথা উঠল।বাবুন নানা প্রশ্ন করতে লাগলো তার মা সম্পর্কে। তার বাবাও বেশ সাগ্রহেই তার মায়ের গল্প শোনাতে লাগলেন বাবুনকে। তার মা নাকি তাকে অনেক ভালবাসত। কতটা ভালবাসত তা জানার বা বোঝার ক্ষমতা নেই বাবুনের। আফসোসের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যেন সে। আর ওদিকে তার বাবার চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়াও বাবুনের দৃষ্টির অগোচরে ঘটল না।
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বাবুন দেখল তার বন্ধুদেরকে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের মায়েরা। এ দৃশ্য অবশ্য আগেও দেখছে বাবুন। কিন্তু কখনো তো মনের মধ্যে এরকম ভাবে মোচড় দিয়ে ওঠে নি তার। কখনো তো সে হাহাকার করে ওঠে নি তার মায়ের জন্য। কখনো তো মায়ের স্নেহ পাবার অতৃপ্ত বাসনা উদয় হয়ে ওঠে নি তার মনের গহীনে। তবে আজ হঠাৎ কি হল তার! মাকে হঠাৎ করেই আজকে তার দেখতে ইচ্ছে করছে খুব, মায়ের কোলে বসে আদর খেতে মন কেমন করছে তার। ইস! যদি সে তারা হতে পারত! যদি যেতে পারত সে তার মায়ের কাছে! কিন্তু কিভাবে যে তারা হতে হয় তা তো সে জানে না। তাহলে সে তার মায়ের কাছে যাবে কিভাবে! আচ্ছা তার মাকে যদি ফিরিয়ে আনা যায় কোনোভাবে! কিন্তু কিভাবে! হঠাৎ তার মনে হল ঐ রং পেন্সিলের কথা। একমাত্র ঐ রং পেন্সিলই পারে তার মাকে ফিরিয়ে দিতে।
সেদিন স্কুলের ক্লাসে তার আর মন বসলো না। স্কুল ছুটি হবার সাথে সাথেই সে ছুটে বাড়ি চলে এল। এসেই মহা উৎসাহে তার সেই পরিচিত ড্রয়িং খাতাটা নিয়ে তার মাকে আঁকতে বসলো সুন্দর করে , সেই ম্যাজিক রংপেন্সিল এর শেষ অংশগুলো দিয়ে।এক পর্যায়ে তার মায়ের ছবি আঁকা শেষ হল বাবুনের। তার মায়ের চেহারার সাথে অবশ্য সেই ছবিতে আঁকা নারীর চেহারার কোনো মিল পাওয়া গেলো না।সেজন্যই হয়তবা বাবুন সে ছবিটার পাশে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিল - 'আমার মা', যাতে কিনা ম্যাজিক রঙ পেন্সিল বুঝতে পারে।
রঙ পেন্সিল এর শেষ অংশ টুকুও একেবারে শেষ বলাই চলে। বাবুন দ্বিধা না করেই সেটুকুও তার মায়ের ছবিতে ঘসে শেষ করে দিল।এখন বাবুনের আর কিছু চাওয়ার নেই, শুধুমাত্র মা ছাড়া। কিছুই যেন সে চায় না, কিছুতেই তার মন ভরবে না। তার চাই শুধুমাত্র মাকে। নির্লজ্জ অবুঝতাই তার একমাত্র হাতিয়ার আজ। ছেলেমানুষির বেড়াজালে নিজেকে আটকে রেখে অবুঝ সেজেই সে যেন মহাখুশি ।
সেদিন রাতে মনে অসম্ভব উল্লাস আর উত্তেজনা নিয়ে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল বাবুন। কিন্তু তার বাবার আর ঘুম আসছে না আজ। তিনি তার ছেলের শেষ আঁকা ছবিটা দেখে ফেলেছেন । এতটাদিন তার ছেলের ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দিয়ে কত বড় অপরাধই না করে ফেলেছেন তিনি। সেই ফুটবল থেকে শুরু করে এযাবৎকাল বাবুনের আঁকা সব ছবিকে বাস্তবে রুপদান তো তিনিই করেছেন। ম্যাজিক রঙ পেন্সিলের মিথ্যে বাস্তবতা তিনি তার ছেলের সামনে না তুলে ধরলেও পারতেন। কিন্তু তিনি তো আসলে ভাবতে পারেন নি, তার ছেলে তার কাছে এতো দামি একটা জিনিস চেয়ে বসবে। সামান্য ফুটবল, চকলেট, খেলনা কেনার সামর্থ্য তো তার ছিলই, তাই তিনি এতদিন ম্যাজিক রঙ পেন্সিলের দোহাই দিয়ে তাকে এসব কিনে দিতেন, কিন্তু মা কেনার সামর্থ্য তার কোথায়!
নাহ, আর তিনি শুয়ে থাকতে পারছেন না। উঠে পরলেন বিছানা থেকে। তার কপালে পড়েছে বিষাদের ভাঁজ, আর চোখের কোণে বিষন্নতার অশ্রু। ঠোঁটদুটো কাঁপছে, সেই সাথে তার হাতের আঙ্গুলগুলোও। সেই কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি রঙ পেন্সিলের বক্সটা খুঁজে নিলেন। তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই আর কোনও রঙ। বারান্দায় গিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আর্ত চিৎকার ও ঐ রংপেন্সিল বক্স - দুটোকেই ছুঁড়ে মারলেন আকাশের দিকে। চিৎকারটা বার কয়েক প্রতিধ্বনিত হল আকাশের দেয়াল গুলোতে। আর রঙ পেন্সিলের বক্সটা রাস্তায় পড়ার একটা ভোঁতা শব্দ শোনা গেল।
বাবুনের বাবা বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। আকাশে মস্ত এক চাঁদ উঠেছে। চাঁদটার পাশে অসংখ্য তারা। সেগুলোর মাঝে কোনটা বাবুনের মা? ভাবতে ভাবতেই কখন যেন জল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে ঠোঁট অবধি । তখনি কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। কে! পিছন ফিরে তাকাতেই বাবুন বলল -
কাঁদছো কেন বাবা!
কোলে তুলে নিলেন বাবুনের বাবা বাবুনকে। খুব করে আদর করতে লাগলেন তিনি বাবুনকে। বাবুন তার বাবার চোখের জল মুছতে মুছতে কেবল বলল-

বাবুনের বাবা কাজ করে কর অফিসে। সে সামান্য একজন পিয়ন মাত্র। সারাদিন খাটাখাটনির পর রাতে যখন বাবুনকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেন তিনি, তখন তিনি যেন ভুলে যান তার সারাদিনের ক্লান্তি। মায়ের অভাব ভোলানোর জন্য তার চেষ্টার কোন কমতি যদিও নেই, তবুও সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টিগুলোর মধ্যে একটা হল মাতৃস্নেহ, একজন শিশুর কাছে যার কোন বিকল্প নেই। দ্বিতীয় বিবাহের কথা অবশ্য অনেকে তাকে পরামর্শ হিসেবে বলেছেন, কিন্তু তিনি সেসব প্রস্তাব সব একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছেন।
বাবুনের বাবা মাঝে মাঝেই বাবুনকে আকাশের গল্প শোনান, সেই সাথে চলে তারা হওয়ার গল্পও। মানুষ মরে গেলে যে তারা হয়ে যায় সেই তারার গল্প।
-ঐ যে তারাটা দেখছ, সব থেকে বেশি জ্বলজ্বল করছে?
-হ্যাঁ।
-ঐটা হলেন তোমার মা।
-আচ্ছা বাবা
-বল।
-মা হঠাৎ তারা হতে গেলেন কেন?
-তারা হলে তো আর কোন দুঃখ থাকে না। চারিদিকে শুধু আনন্দ আর হাসির বন্যা।
-তাহলে বাবা আমরাও কি একদিন তারা হবো?মায়ের কাছে যেতে পারব?
তার বাবা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
বাবার কথা শুনে বেশ আশ্বস্ত হয় বাবুন- যাক তার মা তো তারা হয়ে বেশ আছে। তারা হওয়ার গল্প শুনতে শুনতে বাবুনেরও তারা হওয়ার সাধ জাগে খুব।কিন্তু সে তার বাবাকে ছেড়ে কখনই একা একা তারা হবে না। সে খুব ভালবাসে কিনা তার বাবাকে। এরকমই আরও অনেক শর্ত কল্পনা করতে থাকে সে মনে মনে। যেমন যদি তার বাবা কথা দেয় যে তার হলে তারা দুজনে মায়ের কাছে যেয়ে থাকবে
তবেই শুধুমাত্র সে তারা হতে রাজি হবে, নতুবা নয়।
বাবুনের বাবা যে মাসিক বেতন পান তাতে বাপ বেটার বেশ চলে যায়। বাবুনের বাবার ইচ্ছা বাবুনকে অনেক পড়াশুনা করাবেন। তিনি ছেলেকে যেনতেন স্কুলেও ভর্তি করলেন না। আবার পাছে ছেলে যেন খারাপ ছেলেদের সাথে না মিশতে পারে সেজন্য তিনি ছেলেকে নিয়ে তার অফিসের কাছাকাছি একটা আবাসিক এলাকায় দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটও ভাড়া নিয়ে নিলেন। খরচের দিকে তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তা করলেন না। কিন্তু তার হাঁটুর কাছের ফুটোটা ক্রমশই সকলের দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো।
বাবুনের বই পড়ার খুব শখ, এডভেঞ্চারের বই হলে তো আর কথাই নেই। এই বয়সেই সে চাঁদের পাহাড় শেষ করে ফেলেছে। নানান রকম সুপার হিউম্যানের কমিক্স বুক তো তার ঠোঁটের আগায় বলতে গেলে। সেসব পড়ার সময় সে নিজেকে সুপারবম্যান কিংবা স্পাইডারম্যান ভাবতেও দ্বিধাবোধ করে না। চাঁদের পাহাড় পড়বার সময় সে ভাবে সেই বুঝি শঙ্কর, সে-ই বুঝি হেঁটে চলেছে গহীন অরণ্যের পথ মাড়িয়ে। বাবুনের এসকল কল্পনা অবশ্য তার বাবার অগোচরে নয়। তার বাবা এসব কল্পনার কথা শোনেন আর হাসেন। অসম্ভব সুন্দর সে হাসি, বাবুন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে তা।
ইদানিং বাবুনের মনটা বেশ খারাপ। আগের বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় এসেছে সে বেশ ক মাস হল। কিন্তু নতুন কোনো বন্ধু হয় নি তার। সে অবশ্য চেয়েছিল বন্ধু হতে, সে চেয়েছিল এ পাড়ায় তার বয়সী যে ছেলে গুলো আছে, তাদের সাথে সেও একটা ফুটবল নিয়ে ঠিক বিকেল হলে মাঠ দাপিয়ে বেড়াবে। কিন্তু সে সুযোগ তার আর হল না, কেউ তাকে খেলতে নেয় নি। অগত্যা বারান্দার গ্রিল ধরে মাঠে তার সমবয়সী ছেলেগুলোর ফুটবল খেলা দেখা ছাড়া আর সময় কাটানোর সুযোগ থাকল না তার। ওরা যে তাকে খেলতে নেয় নি তার জন্য কিঞ্চিত দুঃখ পেয়েছে অবশ্য সে, কিন্তু তার মন খারাপের আসল কারণটা অন্য জায়গায়। তার কোনো ফুটবল নেই। তার যদি একটা ফুটবল থাকতো তবে সে একা একাই খেলতে পারত, কোনো বন্ধুর আর দরকার হত না তার। এসবই ভাবতে ভাবতে সে তার ড্রয়িং খাতায় একটা ফুটবলের ছবি আঁকলো।তার বাবা তাকে গতকাল একটা নতুন রঙ পেন্সিল বক্স কিনে দিয়েছে। খুবই যত্নে সেই রংপেঞ্ছিল গুলোই সে ব্যাবহার করেছে। বলা বাহুল্য বাবুন ছোটবেলা থেকেই বেশ ভালো ছবি আঁকে। সে কখনো ছবি আঁকা শেখে নি কারো কাছে, নিজের কল্পনা দিয়েই সে সর্বদা ছবি এঁকে এসেছে। বরাবরের মতন এ ছবিটাও বেশ সুন্দর হল। ছবিটা তার নিজের কাছেই বেশ পছন্দসই হয়েছে। যদি তার ঠিক এমনি একটা ফুটবল থাকত।ইস! ভাবতেই বিষণ্ণতা লাগে তার মনে। বারকয়েক ফুটবলটায় হাত বুলিয়ে খাতাটা বন্ধ করে আবারো বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা রাখল বাবুন। কি যেন একটা গোলাকার বস্তুতে ধাক্কা খেল তার পা। বাবুন তাকিয়ে দেখল সামনে। ওমা! একি! এসে সত্যিকারের একটা আস্ত ফুটবল। গভীর বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দু হাত দিয়ে বলটা তুলে নিল সে। বলটি দেখতে তার আগেরদিন আঁকা বলটার মতন অবিকল। বাবুন যেন কিছুতেই কিছু বিশ্বাস করতে পারছে না। এবার সে কি মনে করে বলটাকে কোলে নিয়ে দৌড় দিল তার টেবিলের কাছে। টেবিলের ঠিক উপরেই তার ড্রয়িং খাতাটা রাখা আছে।সে খাতাটা খুলে তার গতকালের আঁকা ফুটবলটার ছবি খুঁজতে লাগল।কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড! তার আঁকা সব কটি ছবিই সেখানে আছে কেবল মাত্র গতকালকের আঁকা সেই ফুটবলের ছবিটিই শুধু নেই। বাবুন কেমন জানি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই যেন সে বুঝতে পারছে না। তবে সে কি ম্যাজিক রঙ পেন্সিল পেয়েছে? তার বাবা তাকে যে রঙ পেন্সিল বক্সটা উপহার দিয়েছিল তাতে থাকা সব কটি পেন্সিলই কি তাহলে ম্যাজিক দিয়ে তৈরি?ম্যাজিক পেন্সিল বা কলমের গল্প অবশ্য সে আগে পড়েছে গল্পের বইয়ে।কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব! নিজের চোখ দুটোকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না বাবুন। তার বারবার মনে হচ্ছে সে যেন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ওদিকে তার আনন্দের বাঁধ ভেঙ্গে হাসির প্লাবন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়টাকে।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই তার পালা এল তার রঙ পেন্সিল গুলোর সত্যতা পরীক্ষা করার। সে সেই ড্রয়িং খাতা আর পেন্সিল গুলোকে নিয়ে বশে পড়ল আঁকতে। কিন্তু এবার সে কি আঁকবে! কিছুতেই যেন সে ভেবে পাচ্ছে না। কি মনে করে সে এবার একটা সুন্দর জামা একে ফেলল। পরদিন সকালে বাবুন বেশ আগ্রহ নিয়েই ঘুম থেকে উঠলো। প্রথম দিনের মতন আজকেও সে তার খাতায় আঁকা জিনিসটা দেখতে পেল তার বালিশের ঠিক পাশেই। একই সাথে তার খাতায় আঁকা ছবিটিও ভ্যানিশ। এবার বাবুনের মনে আর কোনও সংশয় রইল না। সে এবার নিস্তিত যে সে এই ম্যাজিক রঙ পেন্সিলের একাধিপত্য অধিকারী। তার আনন্দের সীমা যেন ক্রমশই ছারিয়ে যেতে লাগলো । আনন্দে নাচতে লাগলো সে। চিৎকার করে এ ঘর থেকে ওঘর ওঘর থেকে এঘর করতে লাগলো সে।
এমনি করে বাবুন প্রতিদিন স্কুল সেরে বাড়িতে ফিরেই আঁকার খাতা আর রঙ পেন্সিল নিয়ে বসে, আর তার পছন্দ মতন জিনিস আঁকিবুঁকি করে। আর তার সেই আঁকা ছবিগুলো সকাল হলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় হাওয়ায় এবং বাবুনের ঘুম ভাঙ্গার ঠিক আগ মুহূর্তে অলৌকিকভাবে বাস্তবরূপ নিয়ে ফিরে আসে বাবুনের কাছে। বাবুনের দিনগুলো এভাবে বেশ মজায় কাটতে লাগলো। কোনদিন সে রসগোল্লার ছবি আঁকে, কোনদিন বা চকলেট, কোনদিন আইসক্রিম, আবার কোন কোন দিন সে আঁকে তার পছন্দমত বিভিন্ন খেলনার ছবি। এমনি করে দিনকে দিন বাবুনের খেলনার বাক্সটা পূর্ণ হয়ে এল। বাবুনের এখন আর সঙ্গী না থাকার কষ্ট নেই। মন খারাপ ও আর তার হয় না সচারচর। এখন তার সব থেকে ভালো বন্ধু হল তার রঙ পেন্সিল।
একদিন হঠাৎ বাবা বাবুনকে বারান্দায় বসে কাঁদতে দেখলেন। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে জানতে চাইলেন তার কান্নার কারণ। প্রথমে তো বাবুন কিছুতেই তা বলবে না। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবুনের কান্নার কারণ আবিস্কার করলেন তার বাবা। বাবুনের সেই সাধের রংপেন্সিল বক্সের সব কটি পেন্সিলই প্রায় শেষ হবার পথে, যা অবশিষ্ট রয়েছে তা দিয়ে বড়জোর দুইটা কি একটা ছবি আঁকতে পারবে বাবুন। তারপর বাবুন কি করবে! আবার সে কি একা হয়ে পড়বে! আবার বন্ধুহীনতার কষ্ট তাকে গ্রাস করবে! বাবুনের বাবা যেন খানিকটা অবুঝের মতনই তার ছেলেকে আশ্বাস দিলেন আরেকটা নতুন রঙ পেন্সিল কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু বাবুনের কান্না তবুও থামে না। অবশেষে বেশ জোরাজোরিতে প্রকৃত ঘটনা বলল বাবুন। ওগুলো যে কোন সাধারণ রঙ পেন্সিল নয়, ম্যাজিক রঙ পেন্সিল - তা বলল বাবুন তার বাবাকে। তার বাবা মুখ টিপে হাসলেন খানিকটা। বললেন-তাহলে এক কাজ কর, ওই ম্যজিক রঙ পেন্সিলের বাকি অংশ টুকু দিয়েই নাহয় আরেকটি ম্যাজিক রংপেন্সিল বক্স এঁকে ফেলো, তবে তো তুমি নতুন ম্যাজিক রঙ পেন্সিল বক্স পেয়েই যাচ্ছ।
বুদ্ধিটা খুব ভালো লেগেছে বাবুনের।এবার সে কান্না থামিয়ে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। সেদিন রাতে খাবার পর বেশ কিছুক্ষন গল্পগুজব চলল বাপ বেটার মধ্যে। নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাবুনের মায়ের কথা উঠল।বাবুন নানা প্রশ্ন করতে লাগলো তার মা সম্পর্কে। তার বাবাও বেশ সাগ্রহেই তার মায়ের গল্প শোনাতে লাগলেন বাবুনকে। তার মা নাকি তাকে অনেক ভালবাসত। কতটা ভালবাসত তা জানার বা বোঝার ক্ষমতা নেই বাবুনের। আফসোসের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যেন সে। আর ওদিকে তার বাবার চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়াও বাবুনের দৃষ্টির অগোচরে ঘটল না।
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বাবুন দেখল তার বন্ধুদেরকে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের মায়েরা। এ দৃশ্য অবশ্য আগেও দেখছে বাবুন। কিন্তু কখনো তো মনের মধ্যে এরকম ভাবে মোচড় দিয়ে ওঠে নি তার। কখনো তো সে হাহাকার করে ওঠে নি তার মায়ের জন্য। কখনো তো মায়ের স্নেহ পাবার অতৃপ্ত বাসনা উদয় হয়ে ওঠে নি তার মনের গহীনে। তবে আজ হঠাৎ কি হল তার! মাকে হঠাৎ করেই আজকে তার দেখতে ইচ্ছে করছে খুব, মায়ের কোলে বসে আদর খেতে মন কেমন করছে তার। ইস! যদি সে তারা হতে পারত! যদি যেতে পারত সে তার মায়ের কাছে! কিন্তু কিভাবে যে তারা হতে হয় তা তো সে জানে না। তাহলে সে তার মায়ের কাছে যাবে কিভাবে! আচ্ছা তার মাকে যদি ফিরিয়ে আনা যায় কোনোভাবে! কিন্তু কিভাবে! হঠাৎ তার মনে হল ঐ রং পেন্সিলের কথা। একমাত্র ঐ রং পেন্সিলই পারে তার মাকে ফিরিয়ে দিতে।
সেদিন স্কুলের ক্লাসে তার আর মন বসলো না। স্কুল ছুটি হবার সাথে সাথেই সে ছুটে বাড়ি চলে এল। এসেই মহা উৎসাহে তার সেই পরিচিত ড্রয়িং খাতাটা নিয়ে তার মাকে আঁকতে বসলো সুন্দর করে , সেই ম্যাজিক রংপেন্সিল এর শেষ অংশগুলো দিয়ে।এক পর্যায়ে তার মায়ের ছবি আঁকা শেষ হল বাবুনের। তার মায়ের চেহারার সাথে অবশ্য সেই ছবিতে আঁকা নারীর চেহারার কোনো মিল পাওয়া গেলো না।সেজন্যই হয়তবা বাবুন সে ছবিটার পাশে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিল - 'আমার মা', যাতে কিনা ম্যাজিক রঙ পেন্সিল বুঝতে পারে।
রঙ পেন্সিল এর শেষ অংশ টুকুও একেবারে শেষ বলাই চলে। বাবুন দ্বিধা না করেই সেটুকুও তার মায়ের ছবিতে ঘসে শেষ করে দিল।এখন বাবুনের আর কিছু চাওয়ার নেই, শুধুমাত্র মা ছাড়া। কিছুই যেন সে চায় না, কিছুতেই তার মন ভরবে না। তার চাই শুধুমাত্র মাকে। নির্লজ্জ অবুঝতাই তার একমাত্র হাতিয়ার আজ। ছেলেমানুষির বেড়াজালে নিজেকে আটকে রেখে অবুঝ সেজেই সে যেন মহাখুশি ।
সেদিন রাতে মনে অসম্ভব উল্লাস আর উত্তেজনা নিয়ে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল বাবুন। কিন্তু তার বাবার আর ঘুম আসছে না আজ। তিনি তার ছেলের শেষ আঁকা ছবিটা দেখে ফেলেছেন । এতটাদিন তার ছেলের ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দিয়ে কত বড় অপরাধই না করে ফেলেছেন তিনি। সেই ফুটবল থেকে শুরু করে এযাবৎকাল বাবুনের আঁকা সব ছবিকে বাস্তবে রুপদান তো তিনিই করেছেন। ম্যাজিক রঙ পেন্সিলের মিথ্যে বাস্তবতা তিনি তার ছেলের সামনে না তুলে ধরলেও পারতেন। কিন্তু তিনি তো আসলে ভাবতে পারেন নি, তার ছেলে তার কাছে এতো দামি একটা জিনিস চেয়ে বসবে। সামান্য ফুটবল, চকলেট, খেলনা কেনার সামর্থ্য তো তার ছিলই, তাই তিনি এতদিন ম্যাজিক রঙ পেন্সিলের দোহাই দিয়ে তাকে এসব কিনে দিতেন, কিন্তু মা কেনার সামর্থ্য তার কোথায়!
নাহ, আর তিনি শুয়ে থাকতে পারছেন না। উঠে পরলেন বিছানা থেকে। তার কপালে পড়েছে বিষাদের ভাঁজ, আর চোখের কোণে বিষন্নতার অশ্রু। ঠোঁটদুটো কাঁপছে, সেই সাথে তার হাতের আঙ্গুলগুলোও। সেই কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি রঙ পেন্সিলের বক্সটা খুঁজে নিলেন। তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই আর কোনও রঙ। বারান্দায় গিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আর্ত চিৎকার ও ঐ রংপেন্সিল বক্স - দুটোকেই ছুঁড়ে মারলেন আকাশের দিকে। চিৎকারটা বার কয়েক প্রতিধ্বনিত হল আকাশের দেয়াল গুলোতে। আর রঙ পেন্সিলের বক্সটা রাস্তায় পড়ার একটা ভোঁতা শব্দ শোনা গেল।
বাবুনের বাবা বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। আকাশে মস্ত এক চাঁদ উঠেছে। চাঁদটার পাশে অসংখ্য তারা। সেগুলোর মাঝে কোনটা বাবুনের মা? ভাবতে ভাবতেই কখন যেন জল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে ঠোঁট অবধি । তখনি কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। কে! পিছন ফিরে তাকাতেই বাবুন বলল -
কাঁদছো কেন বাবা!
কোলে তুলে নিলেন বাবুনের বাবা বাবুনকে। খুব করে আদর করতে লাগলেন তিনি বাবুনকে। বাবুন তার বাবার চোখের জল মুছতে মুছতে কেবল বলল-
কেঁদো না বাবা, বড় হয়ে আমি তোমার জন্য একটা মা এনে দেব।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন