মতি মিয়ার একদিন - শাইয়িন কবির
কুয়াশার ভেতর দিয়ে সাইকেল
নিয়ে এগিয়ে আসছে পেপারওয়ালা। ঠন ঠন আওয়াজ হচ্ছে ভাঙা সাইকেল এ।
কুয়াশা কাটিয়ে সূর্যটা একটু উকি মেরে আবার ডুব দিলো। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চুলায় আগুন
জ্বলে উঠেছে। কে একজন পেপার টা হাতে নিয়ে বলে উঠলো,
"মিয়াভাই! এইবার তো
রেকর্ড পরিমান শীত পড়ছে"
পেপারওয়ালা হাসে।
সাইকেল নিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। বাড়ির সদর দরজার উলটো পাশে একজন পিঠাওয়ালী পিঠা বানাচ্ছে বিক্রির জন্য। সঙ্গে তার ছেলে। বাড়ির দোতলায়
কেউ একজন কফি খাচ্ছে। দৃষ্টি উদাস। পিঠাওয়ালীর দিকে তাকিয়ে...
আমি মতি মিয়া। আব্বা শখ কইরা নাম রাখছিল আব্দুল মতিন।
শখটা মইরা গেছে বহুত আগেই। তাই নামডাও বাঁচলো না। এহন খবরের বিকিকিনি করি। খালির পত্রিকার
খবর না। পত্রিকায় তো কেবল ইতিহাসের খবর আসে। ইতিহাসের ভেতর যে গল্প আছে তার খবর জানে
কয়জন?
এই যে.... যার বাসায়
পত্রিকা টা দিতে যাইতেছি, বড়লোকের বেটা। কত টাকা যে তার ব্যাংকে
আছে তার মনে হয় হিসাবই নাই। কিন্তু প্রত্যেকটা সকালেই দেখি সামনের পিঠাওয়ালীর দিকে
তাকায়া থাকে। কি আছে ওই দৃষ্টিতে? কিডা জানে!
এক বাবা তার শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রাতভ্রমনে বেড়িয়েছেন।
পিঠাওয়ালীর ছেলে আচল ধরে কান্না করছে।
খিদে লেগেছে ওর।
ভাত খাবে।
মা ধমক দেয়। পিঠা বিক্রি হওয়া
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাকে।
ছোট মেয়েটি হঠাৎ বাবাকে বলে, সে পিঠা খাবে....
বাবা সঙ্গে সঙ্গে পিঠা কিনে এনে মেয়েকে দেয়।
পিঠাওয়ালীর ছেলে ভাবে,
ইশ! আমি যদি ওর যায়গায় থাকতে পারতাম।
সে স্বপ্ন দেখে, সে ভাত খাচ্ছে। গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা সাদা ভাত।
ইশ! আমি যদি পারতাম।
সাইকেল এ চড়তে চড়তে মতি মিয়া দেখে আর ভাবে, এর পরের গল্পটাও তার জানা...
কিছুদুর এগিয়েই হঠাৎ বসে পড়ে মেয়েটি, ফোপাতে থাকে, নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হয় কেন কে জানে।
বাবা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একটা ফুটফুটে মেয়ে বাবার কোলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস
করে, “ডাক্তার আংকেল কি বলে দিয়েছে, আমি কবে মরে যাবো?”
বাবা কেঁদে উঠেন। "না মা! তুই মরবি না। ডাক্তার আংকেল মিথ্যা কথা
বলেছে মা।"
সামনে থেকে কয়েকটা ছেলেমেয়ে উচ্ছল হাসি হাসতে হাসতে রাস্তা পেরোয়।
বাবা ভাবে, হয়তো এই বয়সে আমার মেয়েটাও এমন প্রানোচ্ছল থাকতো। কে জানে ততদিন...
বাবা চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ায়।
পেছনে সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে মতি মিয়া....
সে দেখে, জানে ঘটনা পরাম্পরায় শেষটা।
ছেলেগুলো হাটছে। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। একজন বেশ মনমড়া...
- তুষার! মুড অফ ক্যান?
-না এমনিতেই।
- তোদের জন্য এত দুর আসলাম। তোরাই যদি
মনমড়া হয়ে থাকিস, তবে কেমনে কি?
- না দোস্ত। জানিসই তো শীতকালটা হঠাৎই
বিষিয়ে গেছে।
- নাম তো তুষার, শীতকাল বিষায় কেমনে তোর? :P
- কলেজ রিইউনিয়নের
তো ডেট দিয়া দিছে, যাবি না?
হেসে বলে তুষার, নাহ!
- কেন?
- তোরা যা... আমি কোন পরিচয়ে যাবো?
হাসতে লাগে তুষার।
হঠাৎ থতমত খেয়ে ওরা বলে, এইটা কোন
কথা?
হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠবে তুষার। বলবে, এই দোস্ত! আমার একটু বাসায়
যাওয়া লাগবে। আম্মা এর মধ্যেই তিনবার কল দিয়া ফেলছে...
নির্জন একটা রাস্তা দিয়ে হেটে চলে তুষার। কত কি তার মাথায় ঘুরপাক খায়।
এই যেমন সে এখন যেটা ভাবছে তা খানিক টা এমন, " নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি অনেকটা। বন্ধুবান্ধবদের
সংসর্গও প্রচন্ডরকম ভয়ানক বেদনাদায়ক মনে হয়। যখন নিজের অবস্থানটা দেখি, ভেতরটা
কেমন যে করে কিভাবে বোঝাবো ওদের?
এটা হিংসা? হতে পারে....
ফাইভে - এইটে ট্যালেন্টপুল!
ডাবল গোল্ডেন! মানুষ কত আশাই না করতো....
সব জলে গেল ,তাই না?
একসময় লোকে মাথায় তুলে নাঁচতো, আর আজকে? ন্যাশনাল এর ছাত্র, কোন ভবিষ্যত নাই।"
" কি মিয়া! হাসতে হাসতে কই যাও? আমাগোও একটু কও, আমরাও হাসি?"
সামনে কখন দুজন এসে দাঁড়িয়েছে সে টের পায়নি। তাদের দেখলেই বোঝা যায় তারা নেশাগ্রস্ত....
"জ্বী! মানে ভাই...?"
"কিছু দিয়া যাও গো ভাই!"
"কিছু তো সাথে নাই ভাই। সত্যই..."
" একটা চটকানা দিয়া দাঁত সবকয়টা
ফেইলা দিমু। নাটক করো আমার লগে?"
সহকারীর উদ্দেশ্যে বলে, এই দেখ তো! পকেটে কি আছে ওর?
সহকারী পকেট হাতড়ায়। " মানিব্যাগ আছে ভাই। "
খেকিয়ে ওঠে লোকটা, " কিছু নাই না?"
সহকারীকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে ,দেখ তো কত আছে?
- ভাই! এ হালায়
তো ফহিন্নী। দশ টাকার একটা নোট আছে ভাই।
ঠাস করে তুষারকে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে, ওয়ে! এরপর থেকে কিছু নিয়া
বেড়োইবি। আজকে ছাইড়া দিলাম।
ওই! টাহাডা রাইখা মানিব্যাগ টা দিয়া
দে , তিনডা ডার্বির পয়সা তো হইলো।
যা ভাগ!
তুষার আবার ভাবতে লাগে...
হাহ! এরাই ভালো....
আশা নাই, আকাঙ্খা
নাই। চাওয়া নাই, পাওয়া নাই। ধরলাম মারলাম খাইলাম, আবার টুক করে মরেও গেলাম...
মতি মিয়ার সাইকেল ওকে ক্রস করে যায়....
দশ টাকায় কেনা তিনটা বিড়ির একটা বিড়ি ফুঁকছে মাস্তান আর তার সহকারী।
মাস্তান হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে,
বুঝছস! বাপজানের
স্বপ্নডা আছিল আসমান ছুয়া। রক্ত হিম কইরা হাড় ভাইঙ্গা স্বপ্ন দেখত বাপজান
আমাগো নিয়া। অহন সংসারে ইন্দুরের বড় বড় ডিবি। পাও ফালানির জায়গাডা
নাই।আমি,আমারে নিয়া কত স্বপ্নই দেখত মাইনষে। কিছুই আর রইল না।
আহারে পোলাডা কত ভালা আছিল!!!!!!!
এই কথাডা অহন সবখানে হুনা লাগে। তেলচুরারে পক্ষি
ভাইব্বা তার ডানায় স্বপ্ন বানছিলাম কিন্তু মনে আছিল না, তেলাচুরার পাঙ্খা
গজায় মইরবার জন্যি।
আমার জায়গা অহন আন্ধার গলি,সুযোগের
অফেক্ষায় থাহি কহন একটা ভেনটি ব্যাগ হাতের সামনে পাইব।ব্যাগের
কামে দগ্ধ হইয়া বাপজান আর আমার স্বপ্ন রাস্তার মাইয়্যাদের বুকে জমা হয় রোজ
রাইতে.........
আহারে পোলাডা কত ভালা আছিল!!!!!!!!!!!
শেষ করতে না করতেই ফোন বাযে। ফোন হাতে নিয়ে হুশিয়ার ভঙ্গিতে বলে, এই চুপ কর তো, নেতার ফোন....
জ্বী ভাই, ভালো আছেন?...
আচ্ছা ভাই! বিকালে? আইচ্ছা ভাই, চইলা আসমু... আইচ্ছা আইচ্ছা!
সোফায় বসে নেতাগোছের কেউ একজন কথা বলছে এক মধ্যবয়স্ক গরিব লোকের সাথে। সে
একজন দারোয়ান....
সে এসেছে তার মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে....
নেতা বলেন, আরে!
এই ব্যাপারে আমার তরফ থেকে সব ধরনের সাহায্য পাবেন।
কিন্তু মেয়ের বিয়ে বলে কথা, দাওয়াত করবেন না?
- কি বলেন
স্যার? যাইবেন আমার মেয়ের বিয়েতে? আমার মাইয়া তো রাজ কপাইল্যা... [কৃতজ্ঞতায় গদগদ
]
-আরে কি বলেন! আমিতে আপনাতে তফাত কোথায়? আপনার মেয়ে আমার মেয়ে
না?
কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসে দারোয়ানের।
তাড়াতাড়ি পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে, দোয়া কইরেন স্যার! আজ তাইলে
আসি...
- ফি আমানিল্লাহ!
এর মধ্যেই মাস্তান দুইজন এসে হাজির হয়েছে। বেড়িয়ে যায়
দারোয়ান।
"তোরা আসছিস?" নেতার প্রশ্ন। ঘরে থাকা সবার দিকে উদ্দেশ্য করে বিনীতভাবে বললেন, আপনারা একটু বাইরে গিয়ে বসবেন প্লিজ, ওদের সাথে কিছু কথা ছিলো...
দারোয়ান সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে মতি মিয়াকে দেখে থামে....
মতি সাইকেল এর চেইন উঠাচ্ছে।
"আরে মতি মিয়া যে..."
"গণি ভাই! খবর কি?"
"আসছিলাম নেতার কাছে, সামনের তিন তারিখ
মেয়ের বিয়ে, সেই জন্যই..."
" কাজ হইলো?"
" কি যে কও মতি মিয়া! এনাদের মত দিল দরিয়া মানুষ আছে বইলাই দেশটা এহনো টিকা আছে। আহারে!
এমন মানুষ হয়না!"
মতি মিয়া মুচকি হাসে...
ওদিকে গোপন বৈঠক চলে ভেতরে।
ধাড়ি মাস্তান গলাটা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, এবার কন,
এমন জরুরী তলব?
- আরে বলিস
না, গতবছর এক মাস্টার রে ভ্যানিশ করলাম না? এন্টিপার্টির... বড্ড বাড় বাড়ছিল....
- হু?
এহন কি হইছে?
- এন্টিপার্টি
তো জাইনা ফালাইছে গোপন খবর। গোপন সূত্রে খবর পাইলাম, তারা
নাকি আমার উপ্রে নজরদারী করতাছে, বাগে পাইলেই ঘচাং ফুঁ।
- পুলিশরে
জানান না?
- চাইছিলাম..
কিন্তু... বুঝিসই। কেঁচো খুড়তে সাপ বেড়োইলে
প্রবলেম না?
- তাও কথা!
তয় ভাই চিন্তা করিয়েন না। আমরা আছি তো...
- জানের ভয়
বেডা। চিন্তা কি আর সাধে আসে রে?
এরপর হঠাৎ সব নিস্তব্ধ।
মতি মিয়া সূর্যাস্ত দেখে। সূর্যাস্তের সাথে সাথে তার গলায় আটকে থাকা কথাগুলো মিলিয়ে যায় গোধূলিতে...
প্রতিদিনের রাঙ্গা প্রভাতের স্বপ্নগুলান বিমর্ষ সন্ধায়
আইসা মইরা যায়।
জীবনডা পত্রিকার মতই। সকালের তাজা খবর বিকালে বাসি হয়, রাত্তিরে তার যায়গা হয় ডাস্টবিন।
রঙ্গীন বা সাদাকালো, মূল্য কই?
দিনশেষে কিডা বুকে হাত দিয়া বলতে পারে সে ভালো আছে?
কেউই না...
এরপর...
এরপর টলতে টলতে ঘরের দরজা খুলবে মাতাল বড়লোকের
বেটা, তার বিছানায় সাজিয়ে রাখা লেপ কম্বল...
ভাঙ্গা দরজা
খুলে ঘরে ঢোকে পিঠাওয়ালী। ছেলে তার ঘুমাচ্ছে, শীতে জড়সড়। একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ঝোলানো একটাই শাড়ি নিয়ে ছেলের গায়ে দেবে....
একই শীতে জড়সড় হয়ে আছে বড়লোকের
বেটা। লেপ কম্বল সবই আছে তার, কেবল গায়ে তুলে দেয়ার মত কেউ নেই।
বাইরে থেকে দারোয়ানের গলা শোনা যায়, শীতের কামড় থেকে বাঁচতে বিড়ি ফুঁকে আসমানে ছুড়ে দিয়ে চেচাতে থাকে, হুশিয়ার মিয়াভাই! এইবার রেকর্ড
পরিমান শীত পড়ছে....
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন