মধ্যরাতের ফাগুন বিকেল - শাইয়িন কবির







ঘড়ির কাটার অবস্থানটা ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না


তবে রাত যে অনেক, তাতে কোন সংশয় নেই।


চারিদিক নিকষ কালো আঁধারের পর্দায় ছেয়ে আছে,


সম্ভবত লোড শেডিং।


আজকেই এসে উঠেছি এখানে,


এ ঘরে বহুকাল পড়ে থাকা তালাবদ্ধ ভ্যাপসা বাতাস


কেমন অদ্ভুত আর গুমোট পরিবেশ-


মনে হয়-


গোরস্তানের সবচেয়ে পুরোনো যে কবরটা


তার ভেতর শুয়ে আছি।





ছেড়া মশারী


পায়ের কাছে জড় করে রাখা কমদামী কম্বল


একরাশ জমাট বাধা কালো অন্ধকারের সাথে মশার মিতালি


জানালার ফাক গলে সন্তর্পণে উকি দেয়


দুরের একটা গাছ,


তাল- তমাল – বট যেকোন কিছুই হতে পারে;


তার মাথার উপর রুপোলি জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে


ফাল্গুনের গোলগাল চাঁদ।





ছোট্ট একটা হাওয়ার পুঞ্জ


ঘরে ঢুকলো খোলা জানালার শার্সি গলে।


একটু ঠান্ডা পরশ-


কম্বলটা টেনে নিলাম আবার।


হঠাতই সক্রিয় হয়ে ওঠে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়


জানান দিলো,


আমি ছাড়াও আরেকটি প্রশ্বাসের ধীর ইতস্তত পায়চারী।


বড় দরজা যদিও খোলাই থাকে,


তবুও


এই সময়ে আমি ছাড়া এ ঘরে কারো থাকার কথা নয়।


আমার সঙ্গীরা আসতে আসতে আরো দুইদিন।


তাই নিশ্চিত হতে আবার কান পাতলাম,


অনেক দূর থেকে শিশির ভেজা বাতাসে ভেসে আসা শব্দের মত ফিসফিস


দু একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন অন্ধকার হাতড়ে অনেক দিন শ্রোতা খুঁজে বেড়াচ্ছে।


একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কে?


কোন উত্তর নেই,


বিপরীতে কেবল ফিসফিস টা একটু গাঢ় হল।


কে?


ভয়ার্ত গলায় আবার প্রশ্নটা ছুড়লাম শুন্যে।


ভয় পাই,


আজকালকার চোররা তো আর গায়ে তেল মেখে সিধ কাটে না


সাথে ছোড়াছুড়ি- আগ্নেয়াস্ত্র কত কিছুই তো থাকে।





কিন্তু এবার উত্তর এলো,


সুপুরুষোচিত দরাজ গলায়,


আমি।





ছেড়া মশারী-


মশারীর ফোকর দিয়ে আবছায়া অন্ধকারে দেখতে পেলাম লোকটিকে


জ্যোৎস্না রঙের পাঞ্জাবী


মুখটা দেখা যায় না ভালো


তবে তার সারা শরীর জুড়ে বিচ্ছিরি রকম ছোপ ছোপ আঁকা





"আমি কে?"


"নাম বললে চিনবে না।"


"তবে পরিচয়টাই দিন।"


"ইয়ে মানে... আমি এখানে থাকতাম আগে।"


"যাক বাবা! আপনি চোর নন, শুনে ভালো লাগলো, তো এই মাঝরাত্তিরে হুট করে কারো ঘরে ঢুকে পড়াটা কি মাথাওয়ালা লোকের কাজ?"


"মাথা তো নেই, উড়ে গেছে কবে।"


"মানে?"


"কিছু না। দেখলাম তুমি নতুন এসেছ, তাই পরিচিত হতে এলাম।"


"ওহ! র‍্যাগিং? জানেন তো আজকাল র‍্যাগিং এ..."


"খুব কি অসুবিধা করলাম?"


"বাহ! বলা নেই কওয়া নেই। মাঝরাত্তিরে ঘরে এসে বসে আছেন, আবার জিজ্ঞেস করছেন অসুবিধা করলাম কিনা। না না! অসুবিধা কেন? সুবিধাই তো করলেন, না বলুন?"


"আচ্ছা! তবে বসি কিছুক্ষণ? কথা বলি, কতদিন জমজমাট আড্ডা হয় না। একটা সিগারেট হবে?"


"দেখুন! আপনি হয়ত সিনিয়রই হবেন, যথেষ্ট সম্মান জানিয়েই বলছি, আপনি এবার আসতে পারেন।"


"হ্যা বলতেই তো এসেছি।"










এবার বিরক্তিতে ফেটে পড়লাম আমি।


শালা কোত্থেকে যে আসে এসব!


কিন্তু মোঘলের হাতে পড়েছ, আর খানা খাবে না, তা তো হতে পারে না।


সুতরাং তিনি বলেই চললেন।


কিন্তু তখন কে জানতো,


যা ঘটতে চলেছে,


তার চেয়ে আশ্চর্য ঘটনা আমার এ জীবনে আর হয়তো দুটি হবে না।










"ইতিহাসের বহু পথের বাঁক ঘুরে এসে দেখি


ঘটনাবহুল ইতিহাসে ঘটনাগুলোই আছে,


গল্পগুলো হারিয়েছে সেই কবেই।


এক বিকেলের গল্প বলি শোন,


তখন আমার কেবল ফাগুন


রক্তের উষ্ণতা ধমনীতে টের পাই


পাড়ায় পাড়ায় নাটক- ব্রতচারী নাচ-


মুকুলের মাহফিল-কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুল


আর সবুজের স্বরগ্রাম:


কলাপাতা-সবুজ, ফিরোজা, গাঢ় সবুজ, নীল,


তারই মধ্যে বছরের একটি দিনে


রাস্তায় রাস্তায় উঠে আসে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত-


বাতাসের সোহাগে রাত এলো বুনো,


কারা জানি ছাত্রাবাসে মারা গেছে, ‘শোনো


শোনো’, তারপর গলি, ঘর, হ্যারিকেন আলো


মুহূর্তের মতো চুলে হাত বুলালো,






কি! মুখের কথা নিয়া টানাটানি।


না না! এ হতেই পারে না!


‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই!"





মিশমিশে অন্ধকার


ছেড়া মশারী!


পায়ের কাছে জড় করে রাখা কম দামী কম্বল


মশার রাগিণী!


কিছু শব্দ- বাক্য - কথা


কি আশ্চর্য প্রাণ ছড়িয়েছে – এই কিছুক্ষণ আগেও বুঝতে পারি নি।





"তারপর থেকে আর কোন ফাগুন বিকেলে


নীল শাড়ির মেয়েটির সাথে দেখা হয় নি।


মায়ের চিঠিটাও বুক পকেটে


সেই কুমড়ো ফুলের লতা!


আজও আমার বুকে তিনটি বুলেটের আঘাত


চিৎকার করে উঠে ;


যখন এ বায়বীয় চোখে দেখি


কোন এক ফাগুন বিকেলে


রাস্তার মোড়ে


চায়ের আসরে


শিশুর খেলাঘরে


বৈদেশী ভাষার আগ্রাসনে ম্রীয়মান আমার মাতৃভাষা।


আমি মানতে পারি না,


বুকে আমার তিনটি ফুটো


ভেতর দিয়ে আকাশ দেখা যায়।


খুলিটা কি অদ্ভুতভাবে একপাশ থেকে উড়ে গেছে,


দেখবে?"





এরই মধ্যে তিনি কখন ছেড়া মশারীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন


বলতে পারি না


এখন তার আর আমার মধ্যে কেবল পাতলা একটা মশারীর দেয়াল।


একটু ঝুকতেই দেখতে পেলাম


তার অর্ধেক খুলিহীন মাথা-


তিনটে ফুটো বুকে-


আকাশ দেখা যায়।


আর সারা গায়ে শুকনো কৃষ্ণচূড়া রঙের রক্তের ছোপ।





যেন কত শতাব্দীর দুঃস্বপ্নেরা ঘিরে ধরেছে আমায়


আমার দুর্বল হৃদপিণ্ডের জন্য এ বিভীষিকা অসহনীয়।


তাই আর না পেরে বালিশে মুখ গুজে চিৎকার করে উঠলাম-


না!!!!!!!!





সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক ঘড়িতে সুর বেজে উঠলো।


ভয়ে ভয়ে চোখ তুললাম,


বিদ্যুৎ এসে গেছে


ঘরে জ্বলছে একশো ওয়াটের লাল বাতি


পাখাটাও ঘুরতে শুরু করেছে।


হাজার কিলোমিটার বেগে বুকের ভেতর হাপর চলছে।





ভয় আর শঙ্কা নিয়ে মশারীর বাইরে তাকালাম


দেখলাম-


নাহ! কিছুই নেই,


ছেড়া মশারী!


পায়ের কাছে জড় করে রাখা কম দামী কম্বল।


একরাশ মশার সাথে আমার মিতালী।


জানলা গলে উকি দেয় দুরের একটা গাছ,


তাল- তমাল – বট যেকোন কিছুই হতে পারে;


ফাল্গুনী রাতের পশ্চিমে জ্যোৎস্না,


দক্ষিনে মেঘ।


হঠাত ঐ পথে জেগে ওঠে এক আলোর মিছিল,


অষ্পষ্টভাবে ভেসে আসে খুব পরিচিত একটা গানের সুর।


দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে একবার হাসলাম আমি,


এরপর একটা শাল মুড়ি দিয়ে মিশে গেলাম





প্রভাতফেরীর দলে...







মন্তব্যসমূহ