লেংটু - জয়ন্ত

                     অনেকদিন পর  আজ সকালে দেখা হল লেংটুর সাথেপ্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছিলাম কিনা বলতে পারি নাতবে আমাকে দেখার পর ওর বিস্ময়হীনতা আমায় যে বিস্মিত করল তা নির্ধিদায় বলতে পারিএখন অবশ্য লেংটু নামটা আর ওর সাথে যায় নাপা থেকে মাথা পর্যন্ত আবৃত কিনাকেবল মুখমণ্ডলটি উঁকি মারছে সস্তা মানকিক্যাপের ফাঁক দিয়েওর আসল নামটা অবশ্য জানা হয়নি জ্ঞান হবার পরবর্তী সময়  থেকে এখনো পর্যন্তকথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম ওর আসল নামটা মৃদু হাসলোবাদাম চিবোতে চিবোতে শুধুমাত্র বলল যে,আমার ছোটগল্পের নায়ক হবার নাকি ওর কোনদিন ইচ্ছা ছিল নাআমিও আর কথা বাড়ালাম না,বরং প্রতিউত্তরে একগাল ছোট্ট হাসি দিলাম


                    বয়সে
লেংটু আমার থেকে বড় ছিলকত বছরের তা ঠিক জানি না,অনুমান করতেও পারছি না অবশ্য কখনো সেটা জানবার প্রয়োজন কখনো  অনুভব করেছিলাম কিনা তা মনে পড়ে না ছোটবেলা থেকেই ছেলে বুড়োর মুখে লেংটু নামটা শুনে শুনে অভ্যস্ততাই আমার পক্ষ থেকে ওর প্রতি সম্বোধনটারও কখনও বাতিক্রম ঘটে নিএই কারণে যে লেংটু খুব একটা বিচলিত কিংবা আহত হতো তা অবশ্য নয় বয়সটায় আমিও নগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছি বহুবারগ্রামের রাস্তা দিয়ে জামা কাপড় খুলে হুল্লোড় বাধিয়েছি দলবেঁধে, নদীতে ঝাঁপ মেরেছি নগ্ন শরীরে কাঁদা মাঠে নারকেল দিয়ে ফুটবল খেলেছিতবুও লেংটু উপাধিটা কিন্তু ছাড়া আর কেউ পায় নি



                    গ্রামটা চলছিলো অভাবের মধ্যে দিয়ে,দুরভিক্ষের থেকে খুব কম কিছু নয় অনাবৃষ্টিতে ফসল ফলে নি কয়েক বছর শুধুমাত্র  আমাদের গ্রাম নয়, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলতেও বলা যায় একই দশাতার মাঝে লেংটুদের দুইজনের সংসারে অভাবের চরম পর্যায় নেমে এসেছিলতাদেরকে গ্রামের তথাকথিত সবথেকে গরীব পরিবার বললে কোন ভুল হবে নালেংটুর বাবা মারা যাবার পর থেকেই তাদের ভাত কাপড়ের অভাব দেখা দেয় লেংটু নামটার উপহাস সে হয়তবা কখনো গায়ে মাখত না,কিন্তু বয়সেই তার নিজের গোপনাঙ্গ ঢাকার যে একটা ক্ষিধে ছিল মনের মধ্যে তা তখন বুঝতে পারি নি,আজ পারছি



                  সেবার শরতে ঘুড়ির লড়াই লেগেছিলগলা সমান পানি টপকে সাতমাঝির চরে গেলাম লড়াই দেখতে,লেংটু সাথেই ছিল রং বেরং এর ঘুড়ি উড়ছে,তা দেখতেই বাস্ত হয়ে পড়লাম সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম একা একা, লেংটুকে পেলাম না কোথাও বাড়িতে এসে জানতে পারলাম বুড়ো বটের নিচে নাকি শালিস বসেছে লেংটুকে নিয়ে বামন পুরুতের ধুতি চুরির দায় উঠেছে নাকি তার বিরুদ্ধেআমি বড় দেরি করলাম না ঘটনার শিকড় চিবানোর আগেই দেখলাম লেংটুকে বাঁধা হচ্ছে বটগাছের সাথে সারারাত তাকে বেঁধে রাখা হল ওখানেএই অভাবের দিনে কারো বাড়ির ন্যাকড়াও অনেক দামি, আর তো গোটা একটা কাপড়লেংটু অনেকটা কেঁদেছিল সেদিনআর লেংটুর বেহায়াপনার শাস্তি দিতে পেরে গ্রাম্য পঞ্চায়েত হেসেছিল তৃপ্তির হাসিতবে বিধবা মায়ের কান্নাটা সেদিন কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি


                      লেংটুর সাথে শেষ আমার দেখা যেদিন ওর মা মারা যায়মৃতদেহটাকে ঘিরে ধরে কান্নাকাটির একটা বড়সড় মহড়া চলছিলো সময়টায় ওতো কিছু জেনে উঠতে পারি নি,তবে শুনেছিলাম ওর মা নাকি বিষ খেয়েছিলআর শুনেছিলাম এখন থেকে নাকি লেংটুদের বাড়ির পিছনের তাল গাছটায় ওর মৃত মা থাকবেদিন কয়েকের মধ্যেই ওর মা কে নিয়ে বেশ কতগুলো কল্পকাহিনী তৈরি হয়ে গেলগানের আসর থেকে নেশার আসর - সবকিছুতেই চলতে লাগলো সেসব গল্পছেলে বুড়ো সকলে মিলে সাগ্রহে গিলতো সেসবআমিও ছেলেমানুষির দোহাই দিয়ে বসতাম গল্পের আসরেদু একজন কানাকানি করে বলত লেংটুমায়ের নাকি

পেট হয়েছিল হাসতাম আমি সেসব কথা শুনে,এখন মনে পড়লে কান্না আসেআবার একদিন কানাঘুষো শুনেছিলাম যে, লেংটুর মা নাকি লেংটুর বাপটাকে খেয়েছে,আর অন্দরমহলে নাকি পরপুরুষ ভিড়চ্ছিল মানুষ মরে গেলে হয় কেচ্ছা রটে নতুবা প্রসংসামাঝামাঝি কোনকিছু কারো মাথায় আসে নাআর তাছাড়া আসবেই বা কেন?পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কিনা! এখানে জারজ সন্তানের মা সমাজ থেকে বিতাড়িত হয় এবং সেই বিতাড়নে অংশ নেয় শুক্রাণুদাতারা প্রাচীন যুগ থেকেই এই নিয়ম চলে আসছেএখনই বা বদলাবে কেন শুনি! আজ মনে হচ্ছে লেংটুর মা বিষ খেয়েছিল বেশ করেছিলো নতুবা নির্মমভাবে তীক্ষ্ণ তিরস্কারের আঘাতে একদিন তাকে মরতেই হতো



                    সেদিন এতটা কিছু ভাবতে পারিনি,আজ পারছি কিভাবে তা জানি নাতবে লেংটুর মায়ের মৃত্যুতে লেংটুর মুখভঙ্গি দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম হ্যাঁ ,আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি ওর মুখে হাসি দেখেছিলামওর হাসির মর্মটা কয়েক মুহূর্ত পরই আমরা উদঘাটিত করলাম চোখের পাতার কয়েক পলক পড়বার মাঝেই দেখলাম লেংটু ওর মায়ের শরীর থেকে কাপড় টেনে খুলছে বাঁধা দেবার সুযোগ হল না কারোসমস্ত কাপড় খুলে ফেলল সে কোনমতে নিজের মাজায় বেঁধে লেংটু দৌড় দিল যাবার সময় কেবল একটা কথাই শুনতে পেয়েছিলাম, বারবার বলছিল,
            *আমি আর লেংটু নই,আমায় আর কেউ নামটিতে ডেকো না যেন*  



                    তারপর থেকে ওর সাথে আর কখনো দেখা হয় নিএতদিন পর আজ সকালে ওর নির্লিপ্ত মুখটা আবারও দেখলাম এটা সৌভাগ্য কিনা দুর্ভাগ্য তা ঠিক বুঝতে পারলাম নাওর হাতের কাগজের ঠোংগা থেকে একটা বাদাম নিয়ে ভাঙতে ভাঙতে জিজ্ঞাসা করলাম,*মায়ের মৃত্যুশোক অপেক্ষা নগ্নতা ঢাকার আনন্দটা তোর কাছে বড় হল!*

                  প্রতিউত্তরে যা বলল তা শুনে আমি আর ওখানে বসলাম না সোজা উঠে হাঁটতে লাগলাম পিছনে একবার ফিরলাম,দেখলাম এখনো নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বাদাম খাচ্ছেএখন আমার রক্তে রক্তে প্রতিধ্বনিত হয়ে করনগহব্বরে বাজছে ওর শেষ কথাটা,

                         * মাকে আমিই বিষ দিয়েছিলাম *………………………………………………………………..












মন্তব্যসমূহ