নারী নির্যাতন : সমাজ বাস্তবতা - সুধীর বিশ্বাস
নির্যাতন শব্দটি এবং ইহার মর্মান্তিকতা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর ধারনা রহিয়াছে। তাহার পরও 'নির্যাতন', 'নারী নির্যাতন' এবং 'সমাজ বাস্তবতা' সম্পর্কে আমার কিছু বলিবার আছে।
নির্যাতন হইলো তাহা, যাহা কোন জীব বিশেষকে শারীরিক বা মানসিকভাবে পীড়া দেয়। সেই দৃষ্টিকোণে বিবেচনা করিলে আমরা বলিতে পারি নির্যাতন মূলত দুই প্রকার। প্রথমত শারীরিক এবং দ্বিতীয়ত মানসিক বা আত্মিক। যাহা পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোন যে কোন এক বা একাধিক ইন্দ্রিয় কিংবা শরীরের অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করে তাহা শারীরিক নির্যাতন। পক্ষান্তরে যাহাতে সুস্থ মানসিকতা বিপর্যস্ত হয় তাহাই মানসিক নির্যাতন।
শারীরিক আঘাত সাময়িক বেদনাদায়ক। ঔষধ প্রয়োগে অথবা সেবা শুশ্রূষায় তাহার উপশম সম্ভব। কিন্তু মানসিক আঘাতের কোন ঔষধ নাই, পথ্য নাই; ডাক্তার- কবিরাজ, হেকিম- বৈদ্য কাহারো সাধ্য নাই সেখানে প্রলেপ দেয়। মানসিক যন্ত্রনা মানুষের মনোজগৎকে কুরাইয়া কুরাইয়া খায়, মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে বিপর্যস্ত করিয়া তোলে। মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া অবশেষে মানবেতর এই পৈশাচিক নির্যাতনের স্বীকার হইয়া কেহ কেহ অপ্রকৃতস্থ হইয়া পড়ে। আর কেহবা পরিত্রাণের আশায় জীবন সংগ্রামের ইতি টানিয়া আত্মহননের ন্যায় নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করে।
লিঙ্গভেদে সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান। নারী এবং পুরুষ। অবশ্য ইহার বাহিরে আরো এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাহারা নপুংসক নামে পরিচিত। ইহাদের সংখ্যা অতীব নগন্য।ইহারা ব্যতিক্রম। এখন কথা হইতেছে, এই দ্বিবিধ নির্যাতনের শিকার হইতেছে কাহারা এবং কতটুকু কাহাদের উপর বর্তাইতেছে।
সুপ্রাচীন কাল হইতে সমাজে জনশ্রুতি নারী নির্যাতিতা। নারী অবোলা, নারী অবলা। নারী জাতির এই দুর্বলতার সুযোগে প্রবল পরাক্রমশালী পুরুষজাতি নারীদের উপর প্রভুত্ব করিয়াছে। আর কারনে অকারনে নির্যাতন চালাইয়াছে।
পৌরাণিক গ্রন্থ, মহামনীষী, কবি-সাহিত্যিক , দার্শনিক-রাজনীতিবিদ, পত্র-পত্রিকা, সকল প্রকার সংবাদ মাধ্যম, সকলের মুখে কেবল একই কথা 'নারী নির্যাতন'। হাজারো উদাহরণ টানিয়া সকলেই ইহার প্রতিকারে এবং প্রতিরোধে প্রানান্ত পরিশ্রম ও পরিকল্পনা করিয়া যাইতেছে।
কিন্তু সমাজ বাস্তবতা ভিন্ন। পুরাণ ইতিহাস ঘাটিলে এবং বর্তমানকে বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে তুলনামূলক বিচারে নারী নয়, পুরুষেরাই নারীদের দ্বারা নির্যাতিত হইয়া আসিতেছে আবহমান কাল ধরিয়া। সময় বিশেষে নারীরাও নির্যাতিত হইয়াছে, তবে সেই নির্যাতন শারীরিক, চরমতম মানসিক বা আত্মিক নহে। ছলনাময়ী নারীজাতি কুট কৌশলে অহর্নিশি পুরুষ জাতিকে মানসিক নির্যাতনে নাস্তানাবুদ করিয়া ছাড়িতেছে। পাছে আহার নিদ্রা এবং পারিবারিক - পারিপার্শ্বিক শান্তি বিঘ্নিত হয় এই পরাভয়ে চরম এই সত্য কথাটি কোন পুরুষ মানুষ মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিতেছে না। ইহাইতো পুরুষ নির্যাতনের প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
দেখুন, সতী-সাধ্বী, পতিপরায়ণা বলিয়া পূজিতা দেবী কালী তাঁর স্বামী সত্য সুন্দরের প্রতীক, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরম আরাধ্য দেবতা শিবকে পদতলপৃষ্ঠ করিয়াছেন।জিঘাংসার মত্ততায় মাতিয়া তিনি স্বাভাবিক বেশ ভূষন পরিত্যাগ করিয়া জন্মদিনের বা জন্মক্ষনের পোশাক পড়িতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই। আরও দেখুন, যে দেবী সর্বভূতে শক্তিরূপে, মাতৃরূপে, দুর্গতিনাশিনীরূপে অবস্থান করিতেছেন, যাহার ভজন- পূজন, সাধন-আরাধনায় মানুষ সকল সত্তা সমর্পন করিয়াছে সেই দেবী কত নির্মম, কত নিষ্ঠুর, কত নৃশংস আর কত পৈশাচিকতার পরিচয় দিয়াছেন। পুরুষ শক্তিকে পদানত করিবার মানসে তিনি তাহার মোহিনী রূপ প্রদর্শন করাইয়া সকল দেব দেবীকে তাহার নিকট আত্মসমর্পণ করাইয়াছেন। দেবশক্তি আর পশুশক্তির আক্রমনে পরাস্ত করিয়াছেন মহিষাসুরকে। সর্পের দেবী মনসা, তাহার ছোবল থেকে পরিত্রান পাইবার আশায় কত মানুষ দুধ-কলা দিয়া তার পূজা অর্চনা করিতেছে। তাহার পরও তাহার ছোবল হইতে মানুষ নিস্তার পাইতেছে না। অযোদ্ধার রাজা দশরথের পত্নী কৈকেয়ী আর তাহার দাসী কুজি মন্থরার নির্মম নির্যাতনের শিকার হইয়া রামকে বনবাসে যাইতে হইয়াছিল। পুত্র-বিরহে মানসিক যন্ত্রনাকাতর রাজা দশরথের হইয়াছে অকাল মৃত্যু । সোহাগী বোন সূঁর্পনখার কুপরামর্শে রাবন রাজা সীতাকে অপহরন কমরিয়াছে। ধ্বংস হইয়াছে স্বর্নলঙ্কা। সবংশে নিধন হইয়াছে রাবন রাজা।
পাঠক, আপনারা হয়ত ভাবিতেছেন, যাহাদের কথা কহিতেছি তাহারা তো আর মানুষ নহেন, তাহারা হইলেন দেবতা অথবা দানব। দানব দেবতার সহিত মানুষের তুলনা করিবেন কেন? তথাস্তু। মানুষেরই কথাই কহিতেছি। ইতিহাসের পাতায় আসুন। মহামতি হাসানের পত্নী জায়েদা স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের হীন মানসিকতায় দেবতুল্য স্বামীকে বিষ প্রয়োগে মারিয়াছে। গ্রীক সম্রাজ্ঞী হেলেনের লালসার আগুনে আত্মাহুতি দিতে হইয়াছে ট্রয় নগরীর যুবরাজ প্যারিসকে। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইয়াছে গোটা ট্রয় নগরী।
বিজ্ঞ পাঠক, আমরা যদি অত্যাধুনিক সভ্য সমাজ ব্যবস্থার জীবন যাত্রার দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহা হইলে দেখিতে পাইব, যাহারা আজ সমাজের উচুতলার বাসিন্দা (অর্থ প্রতিপত্তির মানদন্ডে) যাহারা ব্যবসায় বানিজ্য, চাকুরী, রাজনীতি, জীবন-জীবিকার তাগিদে কিম্বা যে কোন সঙ্গত কারনে পৈত্রিক নিবাস পরিত্যাগ করিয়া অন্যত্র বসবাস করিতেছে, তাহাদের অনেকের সন্তানসন্ততিদদের তাহাদের বাড়ি কোথায় জানিতে চাহিলে যে উত্তরটি মিলিবে তাহা উহাদের পিতা পিতামহের বাড়ি নহে। উহা হইলো উহাদের মাতামহের বাড়ি। ঐ ছেলেটি বা মেয়েটি মাতৃকুলের বংশপরিচয় সবিস্তারে তোতা, টিয়া, ময়না পাখির মতন বলিয়া দিবে নিখুঁতভাবে। পক্ষান্তরে, পিতৃকুলের কোন কিছু সম্পর্কে সে বিন্দুবিসর্গ অবগত নহে। এমনকি পৈত্রিক নিবাস অর্থাৎ তাহার নিজের বাড়িটি কোথায় তাহাও সে বলিতে পারে না। তাহার এ জ্ঞানের অর্জন এবং বর্জন কি প্রকারে সাধিত হইলো? সহজ সরল সত্যকথাটি হইল, যাহা সে শিখিয়াছে তাহা মাতৃভাষায় তাহার মাতার নিকট হইতে। আর যাহা শিখে নাই তাহাতেও তাহার মাতার কৃতিত্ব শতভাগ। আবার দেখুন, মাতৃকুলের কেহ যদি বেড়াইতে আসে, সে অতি আপনজন অথবা দুরসম্পর্কের আত্মীয় হউক না কেন, তাহার জন্য গৃহকত্রীর দরদ, স্নেহ, ভালোবাসা, প্রীতি উথলিয়া উঠিবে। যাবতীয় কুশলাদী এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে তাহাকে রাজকীয় আপ্যায়নের সকল প্রকারে ব্যবস্থা তিনি গ্রহন করিবেন। চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয় এবম্বিধ আয়োজনে তিনি থাকেন ব্যতিব্যস্ত। যাইবার কালে স্বামীর কষ্টার্জিত টাকায় খরিদ করিয়া আনা বিবিধ প্রকারের উপহার উপঢৌকন তাহার হস্তে তুলিয়া দিয়া নয়নজলে ভাসিয়া পুনরায় আসিবার আমন্ত্রন জানায়। বিপরীত চিত্র দেখা যাইবে পিতৃকুলের কাহারো আগমনে। গৃহকর্ত্রী তখন শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক বহুবিধ অসুস্থতার অজুহাতে শয্যাশায়িনী হইবেন। কুশল বিনিময়েও তিনি তখন অক্ষম হইয়া পড়িবেন। বেচারা স্বামীটি তখন অতি গোপনে, সঙ্গোপনে তাহার গৃহের এবং গৃহের বাহিরের যাবতীয় কাজ কর্মের ফাকে ফাকে নিয়ম রক্ষার তাগিদে আগন্তুকের সহিত ব্যবহারের নূন্যতম প্রক্রিয়া সম্পাদন করিবেন। আগন্তুকের বিদায়ে গৃহকর্ত্রীর স্বস্তির নিশ্বাস ফিরিয়া আসে। সকল প্রকারের অসুস্থতা তাহার দূরীভূত হইয়া যায়।
অবস্থানগত দিক বিবেচনা করিয়া দেখুন; নারীজাতি সুকৌশলে সুরক্ষিত, ঝঞ্ঝাটমুক্ত, নিরাপদ পরিবেশে ঘর-গৃহস্থালীর কাজে নিজেদের ব্যাপৃত রাখিয়াছেন। আর পুরুষদের ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিয়াছে ঝিলে-বিলে, পর্বতে-গুহায়, প্রান্তরে-তেপান্তরে, মরুতে-মেরুতে, বনে-বাদারে, সমুদ্রতলে-সাগরজলে। এমনকি দুরধিগম্য চাঁদের দেশে, গ্রহান্তরে পাঠাইতেও কুণ্ঠাবোধ করিতেছেনা। বেচারা পুরুষটিকে প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সহিত সংগ্রাম করিতে হইতেছে। নিজের জন্য যতটা, তাহার অধিক পরিবার পরিজন তথা ঐ 'স্ত্রী' নামক মহিলাটির জৈবিক এবং আত্মিক চাহিদা পুরনের নিমিত্তে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া, রৌদ্রে পুড়িয়া, ঝড়-ঝাপ্টা উপেক্ষা করিয়া বিদেশে বিঁভুইয়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করিতেছেন অর্থ সম্পদ আহরনের তাগিদে। শুধুমাত্র গৃহলক্ষ্মীর একটুখানি সুচিস্মিতা বদনখানি দেখিবার আশায়; তাহার নিকট হইতে এতটুকু আদর, সোহাগ, ভালোবাসা পাইবার আশায়। হতভাগা পুরুষ মানুষটির এত ত্যাগ তিতিক্ষা ও কষ্টার্জিত অর্থে স্ত্রীর অফুরন্ত চাহিদা পুরনে সে যখন ব্যর্থ তখন তাহারি সহধর্মিণী ধারন করে ভয়াল রুদ্রমূর্তি। ভালোবাসা তখন গৃহের জানালা-দরজা দিয়া বাহির হইবার সময় এবং সুযোগ না পাইয়া চার দেওয়ালের মাঝখানে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া মৃত্যুবরন করে। স্ত্রী তাহার আয়তলোচন যুগল আরো বিষ্ফারিত করিয়া পরবর্তীতে যাহা করেন তাহা বিবাহিত পুরুষ মাত্রেই ভূক্তভোগী। আর যাহারা বিবাহ করেন নাই, তাহাদের জন্য পরামর্শ হইলো 'দিল্লীকা লাড্ডুর কাহিনী'। না খাওয়া পর্যন্ত বড়ই আফসোস থাকিয়া যায়, তাই খাইয়া দেখুন। অবশ্য দ্বিতীয়বারের পরামর্শ না খাইবার জন্য।
যাহা হউক,সর্বশেষ কথা হইল, 'নারী' বা 'পুরুষ' নির্যাতন নহে; সর্বক্ষেত্রে যে কশাটি বাস্তব তাহা হইলো দূর্বলের উপর সবলের নির্যাতন। যে ক্ষেত্রে যিনি দূর্বল তিনিই নির্যাতিত। অতএব, একে অন্যকে দোষারোপ করিলে অথবা শুধুমাত্র পুরুষ জাতির বদান্যতার বদৌলতে ইহার সমাধান হইবে ভাবিলে চলিবে না। নারী-পুরুষ উভয়কেই সহনশীল হইতে হইবে, সহমর্মী হইতে হইবে; স্বার্থপরতা পরিহার করিয়া পরার্থপরতায় আত্মনিয়োগ করিতে হইবে। কেবলমাত্র নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সমাজ-সংসারে সুবাতাস বহিয়া যাইতে পারে। অন্যথায় 'যথাঃপূর্বং তথাঃপরং'।
সুধীর বিশ্বাস
প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক
বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ, খুলনা
(শুকতারা সংখ্যা ২০১০ থেকে সংগ্রহীত)
(শুকতারা সংখ্যা ২০১০ থেকে সংগ্রহীত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন