কবরস্থানের পাহারাদার - আফজাল হোসেন
মেঘ
ডাকার বিকট শব্দে মজিদের তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ খুলে গেল। তার চোখ দুটো টকটকে লাল, ঠোঁটের
কোণে ফেনা জমেছে, চেহারা ঢুলুঢুলু। দু'আঙুলের মাঝে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া বিড়ির গোড়াটা
ছুঁড়ে ফেলে সে প্যাকেট থেকে আর একটা বিড়ি বের করে অলস ভঙ্গিতে ধরিয়ে নিল। পায়ের
কাছে পড়ে থাকা আধ খাওয়া চোলাই মদের বোতলটার দিকে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বেশ তৃপ্তি
বোধ করল।
মজিদ স্থানীয় কবরস্থানের পাহারাদার। সারা রাত ধরে সে কবর পাহারা দেয়। দু'পাশে সারি-সারি
কবরের মাঝের কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা ধরে, লাঠি হাতে একটু পর পর চক্কর দিতে হয় তাকে।
একবার চক্কর দিয়ে এসে ছোট্ট খুপরির মত টিনের ছাউনির নীচে রাখা কাঠের বেঞ্চিটায় বসে
জিরিয়ে নেয়। এখানে ফ্লাস্ক ভর্তি চা থাকে। সেই চা দিয়ে গলা ভিজিয়ে আয়েশ করে বিড়ি
টানে। মাঝে-মাঝে গাঁজা ভরা স্পেশাল বিড়ি।
আষাঢ় মাসের মধ্য রাত। আকাশটা মেঘে ঢেকে কেমন গুমোট হয়ে আছে। গুম-গুম করে বিকট শব্দে
মেঘ ডাকছে। সেই সাথে থেমে-থেমে বিদ্যুৎ চমকানোর নীলচে ঝিলিক। বোধ হয় একটু পরেই তুমুল
বেগে বৃষ্টি নামবে।
মজিদের মনটা আজ খুব প্রফুল্ল। আজ পাহারা দিতে আসার আগে চুন্নু ভাইয়ের ঘরে গিয়েছিল
সে। চুন্নু ভাই বস্তিতে গোপনে চোলাই মদ বিক্রি করে। বেশ কয়েক গ্লাস চোলাই আজ গিলেছে
মজিদ। আসার সময় সাথে করে একটা ভরা বোতল নিয়েও এসেছে। বোতলেরও প্রায় অর্ধেক তরল এরই
মধ্যে সাবাড়। অবশ প্রতিদিন মজিদ চোলাই যায় না, যেদিন তার রোজগারপাতি বেশি থাকে শুধু
সেদিন ।
আজ বিকেলে ধনী এক ব্যবসায়ীকে কবর দেয়া হয়েছে এই কবরস্থানে। সেই কবর খোঁড়ার ঠিকা
মজিদ নিয়েছিল। লাশ কবরে নামানোর পরে মাটি চাপা দেওয়া পর্যন্ত কাজের ঠিকা হয় পনেরোশো
টাকা। বিকেলে ব্যবসায়ীকে কবর দেওয়া শেষে, ব্যবসায়ীর ছেলে ঠিকার টাকার সঙ্গে আরও
পাঁচশো টাকা বখশিশ দেয় ।
অবশ্য
সম্পূর্ণ দুই হাজার টাকা মজিদের পকেটে যায়নি। কবর খোড়ার কাজে সাথে থাকা আর এক গোরখোদক
সবুরকে দিতে হয়েছে সাতশো টাকা। মজিদ বিড়ির প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে দেখে গাঁজা ভরা
বিড়ি ছয়টা আছে। গাঁজা ভরা বিড়ি আজ দশটা এনেছিল। এরই মধ্যে চারটা খাওয়া হয়ে গেছে।
মদের নেশাটা ধরে রাখার জন্য বিড়ি একটু বেশিই খেতে হচ্ছে।
মজিদ ফ্লাস্কের মুখে কিছুটা চা ঢেলে নিল। আজ আবার আড়াইশো গ্রাম নোনতা বিস্কিটও এনেছে।
চা খাওয়ার আগে দুটো বিস্কিট মুখে পুরে নিল। পেটে তেমন খিদে নেই, তার পরেও চায়ের সাথে
নোনতা বিস্কিট খেতে তার খুব ভাল লাগে। আজ চন্নু ভাইয়ের ওখানে চোলাই খেয়েছে শিক কাবাব
দিয়ে। চুনু ভাইয়ের ছোকরাটাকে পাঠিয়ে মদিনা রেস্টুরেন্ট থেকে একশো টাকার শিক কাবাব
আনিয়েছিল। কী স্বাদ ছিল সেই গরম শিক কাবাবের!
চা শেষ করে একটা বিড়ি ধরিয়ে বেঞ্চিতে গা এলিয়ে বসল মজিদ। শরীরে আরামদায়ক ঝিমুনি।
নিজেকে আজ খুব সুখী-সুখী লাগছে তার। রোজ যদি এমন কিছু বাড়তি টাকা আয় হত, তা হলে মন্দ
হত না। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ পাহারাদারির বেতন দেয় মাত্র দুই হাজার টাকা। আজকালকার দিনে
দুই হাজার টাকায় কী হয়। প্রতি রাতে চা, বিড়ি, গাঁজার পিছনেই তো খরচ হয় প্রায় পঞ্চাশ-ষাট
টাকার মত। তবু ভাল কবর খোঁড়ার কাজ করে মাঝে-মাঝে কিছু বাড়তি টাকা আয় হয়।
মজিদ ভাই চলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। কবরস্থানের ভিতরে আর একটা চক্কর তার দিতে
হবে। আজকাল আবার লাশ চুরির হিড়িক পড়েছে। প্রায়ই শোনা যায়, এখানে-সেখানে কবর থেকে
লাশ চুরি হয়ে গিয়েছে।
মজিদ কবরস্থানের ভিতরের কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা ধরে টলতে-টলতে হাঁটছে। দু'পাশে সারি-সারি
কবর। হাঁটতে হাঁটতে লাঠি দিয়ে রাস্তায় মৃদু আঘাত করে ঠক-ঠক শব্দ করছে। নির্জন-নিস্তব্ধ
এই কবরস্থানে লাঠির ঠক-ঠক মনে সাহস এনে দেয়।
মজিদ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কবরস্থানের দক্ষিণ দিকে। কারণ সেদিকে নতুন কবরগুলো। নতুন
কবর নিয়েই যত দুশ্চিন্তা । শুধু চোরের ভয় নয়, শিয়াল-কুকুরের ভয়ও আছে।
মজিদ কবরস্থানের দক্ষিণ মাথায় পৌঁছে গেল । টর্চের আলো ফেলে সবকটা নতুন কবর ভাল করে
দেখল । নাহ, সব ঠিক আছে। আজ দেওয়া নতুন কবর দুটির একেবারে পাশে গিয়ে দাঁড়াল - ব্যবসায়ীর
কবরের পাশে আরও একটি নতুন কবর হয়েছে আজ। এই কবরটা দেয়া হয়েছে এশার নামাজের পরে।
তখন মজিদ এখানে ছিল না। সবুর করেছে এই কবরের কাজ। সবুরের কাছে শুনেছে, কলেজ পড়ুয়া
একটা মেয়ের কবর ওটা ।
মজিদ চক্কর শেষে আবার এসে টিনের ছাউনির নীচে বসল। টপ-টপ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি
শুরু হয়েছে। একটা বিড়ি ধরিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যজিদ ভাবতে লাগল, কী এক অদ্ভুত জীবন
তার। রাত কাটাতে হয় কতগুলো মরা মানুষের সাথে। বৃষ্টি ভেজা এমন রাতে পাতলা কাঁথা গায়ে
দিয়ে মিষ্টি একটা বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবার মজাই আলাদা! বউ তো এক সময় তারও ছিল। সোনা
বউটার নাম ছিল কুসুম। কুসুমের টানা-টানা চোখ আর ভারী বুক-নিতম্ভ তাকে যেন পাগল করে
তুলত। তবে বউটাকে মন মিটিয়ে আদর করা যেত না। আদর করতে চাইলেই কেমন যেন এড়িয়ে যেত।
নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলেই বলত, আপনের গাও দিয়া মরা মাইনষের ঘেরান আয়।' বলেই খিলখিল
করে হেসে উঠত।
এক
রাতে পাহারা শেষে মজিদ ফিরে এসে দেখে কুসুম ঘরে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারে
কুসুম বস্তির পাশের ঘরের চটপটিওয়ালা বাবুলের সাথে পালিয়ে ঢাকা গিয়েছে।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো মজিদের। কসুম বাবুলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার
পর পাঁচটা বছর কেটে গেল, মজিদের আর বিয়ে করা হয়নি। তার দিনগুলো কাটছে কবরস্থানকে
ঘিরেই। কবর খোঁড়া, লাশ কবরে নামানোর পরে মাটি চাপা দেওয়া আর রাতে কবর পাহারা দেওয়া।
এটাও কী একটা জীবন! গভীর বিস্বাদে ভরে ওঠে মজিদের মন ।
তীব্র ক্ষোভে বিড়ির গোড়াটা ছুঁড়ে ফেলে বাইরে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। প্যাকেট থেকে
আর একটা বিড়ি বের করে ধরিয়ে আবার ভাবনার জগতে তলিয়ে যায়। কুসুম যখন ছিল তখন শেষ
রাতের দিকে একটু আগেভাগেই সে চলে যেত ঘরে। কুসুম থাকত গভীর ঘুমে তলিয়ে। অনেক ডাকাডাকির
পর কুসুম ঘুমের ঘোরেই উঠে দরজা খুলে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। ঘরে ঢুকে মজিদ ঘুমন্ত
কুসুমের পাশে বসে, কুসুমের গায়ে টর্চের আলো ফেলে দেখত, কুসুম ব্লাউজ ছাড়া শুধু একটা
পাতলা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত কুসুমের পাতলা শাড়ির নীচে ভরাট দুটো
বুকের অস্পষ্ট খাজ তখন চুম্বকের মত টানত তাকে।
মজিদ কুসুমের বুক থেকে ধীরে ধীরে শাড়িটা সরিয়ে ফেলে, টর্চের আলোতে উন্মুক্ত স্তনযুগলের
দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। মনে হত যেন এক জোড়া পদ্ম। দুই পদ্মের মাঝে হিংস্র
পশুর মত মুখ ঘষতে কী ভাল লাগত! কুসুম ঘুম ভেঙে বিরক্তিপূর্ণ গলায় বলে উঠত, 'আপনে অ্যামন
ইবলিসের লাহান করতাছেন ক্যান?
মজিদ উত্তেজনা মিশ্রিত ফিসফিসে গলায় বলত, 'তোর এই শরীলডা হাছাই মোরে ইবলিস কইরা ফেলছে।
আজ কুসুম শুধুই স্মৃতি। গত পাঁচ বছরে কুসুমের সাথে আর দেখা হয়নি। কুসুমের কথা ভাবতে-ভাবতে
মজিদের মাথাটা তেতে উঠল। কত দিন পদ্ম ফোটা নারী দেহ দেখা হয়নি তার। অদ্ভুত এক অস্থিরতায়
ছটফট করতে শুরু করে তার সমস্ত শরীর-মন ।
পায়ের কাছে পড়ে থাকা বোতলের বাকি চোলাইটুকু গলায় ঢেলে, পাজা ভরা বিড়ি ধরিয়ে কষে
দুই-তিনটা টান দেয়ার পর একটা পরিকল্পনা মাথায় আসায় বেশ ভাল লাগে মজিদের।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। গুড় গুড় করে মেঘ ডাকার শব্দের সাথে একটু পর-পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
মজিদ প্যাকেটের শেষ বিড়িটার গোড়া ছুঁড়ে ফেলে, লুঙ্গিটা মালকোচা দিয়ে বেঞ্চির নীচে
রাখা কোদালটা কাঁধের সাথে ঝুলিয়ে, টর্চটা হাতে হনহন করে যেতে থাকে কবরস্থানের দক্ষিণে
মাথার দিকে, যেখানে নতুন কবরগুলো।
ব্যবসায়ীর কবরের পাশের কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির কবরের মাটি কোদাল দিয়ে কেটে- কেটে কবরটি
খুঁড়তে লাগল মজিদ। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে অতি দ্রুততার সাথেই কবরটা খোঁড়া
হয়ে গেল।
এক
এক করে কবরের বাশের টুকরোগুলো উঠিয়ে উপরে এক পাশে রাখল মজিদ। লাশটা এখন দেখা যাচ্ছে।
কবরে সামান্য পানি জমেছে। সেই পানিতে লাশের গায়ের কাফনের কাপড় ভিজে চপচপে হয়ে গেছে।
লাশের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে, মাথার চুল জড়িয়ে বাঁধা ছের বন্দ নামক কাপড়ের
টুকরোটা খুলে ফেলল মজিদ।
মেয়েটির
মাথায় অনেক চুল। খোলা চুলগুলো কাদা পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। কী দারুণ সুন্দর মেয়েটি।
কিছুটা যেন কুসুমের মতা বিদ্যুৎ চমকানোর নীল আলোতে মজিদের কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন
ঘুমিয়ে আছে গভীর ঘুমে। কুসুম যেভাবে ঘুমিয়ে থাকত ঠিক তেমন।
লুঙ্গির কোঁচায় গোঁজা টর্চটা বের করে লাশের গায়ে আলো ফেলে, বুকের উপর থেকে সিনা বন্দ
নামক কাপড়টা সরিয়ে ফেলে, গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল মজিদ। ঠিক কুসুমের মত ভরাট দুটো
স্তন।
উত্তেজনায়
মজিদের চোখ চকচক করছে। মাথা নুইয়ে লাশের বুকের
আরও কাছাকাছি গেল সে।
আতরের
তীব্র গন্ধ নাকে লাগছে তার।
যেই
মুহূর্তে মজিদ ভাবল আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে মুখটা গুঁজে দেবে লাশের দুই বুকের মাঝে, ঠিক তখন
আচমকা লাশের হাত দুটো লাফিয়ে উঠে তার গলা প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় চেপে ধরল । মজিদের হাত
থেকে টর্চটা ছিটকে পড়ল কবরের জমে থাকা পানিতে।
দু-হাতে টেনে গলা চেপে ধরা লাশের হাত দুটো সরাতে চায় মজিদ । কিন্তু এক চুলও সে সরাতে
পারল না লাশের হিমশীতল হাত দুটো। লাশের হাত দুটো যেন পাথরের মত সেঁটে গেছে। হাঁস-ফাঁস
করতে করতে মজিদের গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ করে এক ধরনের দমবন্ধ হওয়া শব্দ বেরুতে থাকে। সেই
সাথে নাক-মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত।
আবার প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝড়ের তীব্র দাপটে কবরের উপরে রাখা বাঁশের টুকরোগুলো
এক এক করে সারিবদ্ধ ভাবে ঢেকে দিল মজিদকে সহ লাশটি। আর কোনও এক অদৃশ্য হাতের ইশারায়
কবরের দু'পাশে স্তূপ করে রাখা মাটিগুলোও ধীরে ধীরে ঢেকে দিতে থাকল কবরটি।
মজিদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই ভেবে নেয় মজিদ হয়তো কুসুমের খোঁজে কাউকে কিছু
না বলে ঢাকা গিয়েছে।
কবরস্থানের নতুন পাহারাদার রাখা হয়েছে। নতুন পাহারাদারের নাম সালাম।
সালামও মজিদের মত গভীর রাতে টর্চের আলো ফেলে কবরস্থানের মাঝের কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা
ধরে লাঠির ঠক-ঠক শব্দ তুলে ঘুরে বেড়ায়।
প্রতি রাতে সালাম দক্ষিণ মাথার একটা কবরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। কারণ তার কাছে
মনে হয় সেই কবরটার ভিতর থেকে ক্ষীণ ভাবে গোঁ-গোঁ ধরনের এক জাতীয় শব্দ হয়। কারও গলা
চেপে ধরলে হাঁস-ফাঁস করতে করতে গলা থেকে যেমন গোঁ-গোঁ শব্দ বের হয় ঠিক তেমন।
(শাইয়িন কবির সম্পাদিত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন