কয়েন
মুঠোবদ্ধ হাতের ফাঁক গলে বৃষ্টির পানির মতো চুইয়ে চুইয়ে কয়েন পড়ে যাওয়ার কথা না থাকলেও, অসাবধানতার কারণে কিংবা ভাগ্যের কোন অপ্রকাশিত খেলার রূপক হিসেবেই হয়তবা তানবিলের হাত থেকে দু’টাকার দু’টো কয়েন টুং টাং শব্দ করে পড়ে গেল।
মূল সড়কের ঠিক পাশে, শব্দ দূষণের প্রাত্যহিক রুটিন যা অনেকটা সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের মতোই চিরন্তন সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে—সেখানে মামুলি কয়েনের আত্মাহুতির করুণ তবে সুরেলা ঝংকার তানবিলের কানে পৌঁছায় না। হাতের তালুর স্পর্শ চুম্বন করে থাকা কয়েন যখন অজানা আকর্ষণে স্পর্শ মুক্ত হয়ে গেল তখনও তানবিল অনুভূতিহীন মানুষের ন্যায় আজ সারাদিনের কর্মপন্থা ঠিক করায় ব্যস্ত।
"ভাইজান, টাকাগুলা আপনের?"—লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কয়েন দু’টো তুলে নেয়। চার টাকার মূল্য এখনকার বাজারে হারিয়ে যাওয়া মসলিন সুতার মতো হয়ে যাচ্ছে। এক টাকায় চল্লিশ মণ চাল পাওয়ার গল্পের মতো করেই একসময় হয়ত কিংবদন্তী চালু হয়ে যাবে—২০১১ সালেও চার টাকায় এক কাপ চা পাওয়া যেত। মানুষ অবাক বিস্ময়ে ভাববে, এটা কিভাবে সম্ভব!
তানবিলের মানিব্যাগ হালকা হয়ে আছে, হালকা কুয়াশা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শীতের আগমনী জানিয়ে গেলেও তার দেহে কোন ভারী পোশাক নেই। হয়ত শরীরের ভেতরের দুঃখ কষ্ট দিয়েই এমনিতেই ভারী হয়ে থাকা সত্তার অবিরাম ছোটাছুটিতে বাহ্যিক সাজসজ্জার বিতাড়ণের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। দুঃখ বেঁচে এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়া হয় না। তবে এই চার টাকা দিয়ে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে কিংবা সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলে একটা গোল্ড লিফ সিগারেট।
যে পৃথিবীতে আমাদের বসবাস, সেখানে দুঃখের মতো মূল্যবান, আপন জিনিসের দাম নেই—মূল্যবান অথচ মূল্যহীন। পিতল দিয়ে তৈরী দু টাকার কয়েনের যে ক্ষমতা সেটাও নেই আমাদের অলংকারের মতো দুঃখগুলোর।
তৃষার বাড়ির দিকে পা বাড়ায় উদ্দেশ্যহীন চলাফেরার বরপূত্র তানবিল। তাদের বাড়ির সামনে যে চা’র দোকান রয়েছে, সেখানে বসে আয়েশ করে এক কাপ চা খাবে বখাটে ছেলের মত করে।
তিন নাম্বার রোডের তিন নাম্বার বাড়ী। চোখ বেধে দিলেও তানবিল পৌছে যাবে সেখানে। ভারী ট্রাফিক পার হতে সমস্যা হলেও দিক চিনতে ভুল হবে না। মূল সড়ক থেকে ধানখেতের আইলের মতো চিকন যে রাস্তাটি চলে গেছে, যার শেষ মাথায় নদী, সে রাস্তাটি ধরে এগিয়ে যায় তানবিল।
কত সুন্দর সময় একসাথে কাটিয়েছে তারা। দুরন্ত নদীর পাশে শান্ত কিশোরের ন্যায় চুপচাপ বসে থাকা বিশাল সবুজ চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বকুল ফুলের পাশে বসে তারা দু’জন দুপুর থেকে সন্ধ্যা হতে দেখেছে। সেই সন্ধ্যা হতে দেখা যে তাদের জীবনে রাত নামিয়ে দিবে, কোনদিন কল্পনাও করেনি দু’জন। এমন রাত যে রাতে চাঁদ ওঠে না কখনো, অনুন্নত মহল্লার মতো থাকে ল্যাম্পপোস্ট বিহীন।
তৃষার বাবা দেখে ফেলেছিল। কাপুরুষের ন্যায় লেজ না থাকলেও লেজ তুলে সেই যে পালাল, আর দু’জনের যোগাযোগ হয়নি। বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা, কাপুরুষত্ব—এই তিনের সম্মিলনে মিলন আর হলো না।
নিরবেই পৌঁছে যায় তানবিল। দোতালার জানালায় ভারী পর্দা ঝুলছে। পায়ের উপর পা তুলে বখাটেপনার ভঙ্গি নেয় সে। চা দিতে বলবে—এই সময় খেয়াল করল, হাত থেকে কয়েন দু’টো আবার পড়ে গেছে।
নিজেকেই যেন বলে, "সামান্য কয়েন ধরে রাখতে পারে না, সে আবার মানুষ কী করে ধরে রাখবে?"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন