অবাঞ্ছিত নিবাস - ল্যান্স শালওয়ে
এক
ময়-মুরুব্বিদের কাছে শোনা-অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। কিন্তু অধিক খুশি হলে কী
হয় তা তাঁরা বলে যাননি। বলে গেলে বোঝা যেত-মামনুন শফিকের এখন কী অবস্থা!
'অধিক খুশিতে খুব সম্ভবত ডগমগ। ডগমগ! ডগমগ!! ডগমগ!!! অতিরিক্ত আনন্দে অনেকটা আইটাই
করছেন তিনি। না, কিছু বলে স্বস্তি পাচ্ছেন না। নেহাত বয়স বেড়ে ভুঁড়ি গজিয়েছে, তা
না হলে ডিগবাজি খাওয়ারও একটা সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
'ও কী!' চেঁচিয়ে ওঠেন মামনুন শফিকের স্ত্রী। “ফুলদানি কেউ এভাবে রাখে? সোজা করে রাখো।
গড়িয়ে পড়ে যাবে তো!”
আরে তাই তো, খেয়াল করেননি তিনি। ফুলদানিটা সোজা করে রেখে তিনি লজ্জিত চোখে স্ত্রীর
দিকে তাকান। এসব গেরস্থ কাজ তিনি জীবনে করেননি। ওকালতি তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি ।
কিন্তু তারপরও নিজের ঘর বলে কথা। আহা! কে ভাবতে পেরেছিল, এমন আকালের যুগে ঢাকা শহরের
মত জায়গায় এত সস্তা দরে বাড়ি কিনে ফেলবেন!
অবশ্য বাড়িটার জন্য একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য প্রাক্তন মালিকেরও। রেডিমেড বাড়ি। তাও দাম
নিয়ে তেমন একটা দরাদরি করেননি। করবেনই বা কী? লোকটার এ কূলও গেল-ও কূলও গেল।
বেচারা!
'বুঝলে, লাবণী....”
'হুম।' কুশনগুলো সোফায় সাজাতে
সাজাতে উত্তর দেন।
'বল তো, পৃথিবীতে কোন্ দুটো
জিনিস মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয় না?'
'জানি না তো,' বলতে বলতে ধপ
করে সোফায় বসে পড়েন লাবণী। মোটা থলথলে শরীর নিয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকেন। মধ্যবয়স,
কাজ আর মানবে কেন? ফোঁস ফোঁস করে হাঁফ ছাড়তে ছাড়তে লাবণী বললেন, 'হঠাৎ এ কথা জানতে
চাইছ কেন?'
'ওহ হো! উত্তর জানতে চেয়েছি,
প্রশ্ন নয়।'
'বললাম তো জানি না। তুমি বল,
শুনি,' উন্নাসিক কণ্ঠে বললেন লাবণী।
'শোনো তা হলে, সে দুটো হচ্ছে—সন্তান
আর সম্পদ।' বলতে বলতে স্ত্রীর দিকে যেই না তাকিয়েছেন, অমনি তাঁর চেহারাটা আমসি মেরে
গেল। বুঝতে পারলেন, কথাটা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারেননি। স্ত্রী অন্যভাবে নিয়েছে। মুখটা
কেমন কালো করে ফেলেছে।
'ইয়ে...’ ফাঁড়া কাটাতে চেষ্টা
করেন তিনি, ‘তুমি আবার কী ভাবতে কী ভাবছ? আমি আসলে ওই মিন করে কথাটা বলিনি। বিশ্বাস
করো...'
‘থাক,’ কথা কেড়ে নেন লাবণী,
‘তোমার আর দোষ কী? বিয়ের এগারোটা বছরেও তোমাকে একটা সন্তানের মুখ দেখাতে পারিনি, শান্তি
আর...' বলতে বলতে মাথা নিচু করে চুপ করে যান। নারী জাতির চোখের জল ঢাকার চেষ্টা।
বেশ বিব্রত হন মামনুন। 'এই
দেখো! পুরো কথা আগে শুনবে তো! সন্তান আর সম্পদের কথা আমি আমাদের ইয়েতে বলিনি—বলছিলাম
এ বাড়ির আগের মালিকের কথা। সন্তান থেকেও নেই। একমাত্র ছেলে, তাও বাপকে দেখতে লণ্ডন
ছেড়ে দেশে আসবে না। স্ত্রীও মারা গেলেন গেল মাসে। বেচারার এখন সম্পদ নিয়েও কোনও মাথা
ব্যথা নেই। কেমন জলের দরে বাড়িটা বেচে দিয়ে গেল।'
'কোথায় যাবেন বলেছেন কিছু?'
আসল ব্যাপার বুঝতে পেরে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করেন লাবণী।
'গ্রামের বাড়িই তো বললেন।'
'লোকটার জন্য কষ্ট হচ্ছে।
কত স্বপ্ন নিয়েই না বাড়ি করেছেন। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ বাড়ির প্রতিটা রুমে, ব্যালকনিতে,
ছাদে...
'এহ! ভাল কথা মনে করেছ তো!
শোনো শোনো...' স্ত্রীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন মামনুন, 'তুমি কিন্তু
আজকালই ছাদে টাদে যেয়ো না। কাপড়-চোপড় শুকাতে দেয়ার থাকলে ব্যালকনিতেই দিয়ো।'
'কেন!' বিস্মিত হয় লাবণী।
এমন অসম্ভব কথাও স্বামী বলতে পারল? নিজের বাড়ির ছাদ, আর নিজেরাই যাবে না? এও কী হয়?
'না, মানে...' ব্যাপারটা কীভাবে
বললে কম হাস্যকর মনে হবে, তাই আগপাছ ভেবে নেন মামনুন শফিক। 'আসলে হয়েছে কী... বাড়ির
মালিক যিনি ছিলেন, তিনি যাওয়ার আগে বলে গেছেন, এ বাড়ির ছাদে যেন না যাই।'
'তারপর!' এখনও যেন বিশ্বাস
হচ্ছে না স্বামীর কথা। এসব কী বলছে সে!
'তারপর আর কী? মিলাদ পড়িয়ে
তারপর যাওয়া ভাল। বুঝলে না, কত খারাপ কিছু ঘোরা ফেরা করে ছাদে। তা ছাড়া শোননি কখনও,
বাড়ির মালিকানা বদল হলে আছরের দোষ হয়, মিলাদ পড়িয়ে বাড়ি বন্ধ করতে হয়। তা না
হলে...'
রিনরিনে হাসির শব্দে থামতে
হয় তাঁকে। অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতটা বছরে অনেকটা মোটা হয়েছে স্ত্রী।
বয়স হামাগুড়ি দিচ্ছে কালো হয়ে বসে যাওয়া চোখে, কমে পাতলা হয়ে আসা চুলে, থলথলে
মেদবহুল শরীরে। কিন্তু এই মিষ্টি হাসির একটুকুও পরিবর্তন হয়নি।
কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলতে
পারলেন লাবণী, 'তার মানে তুমি ভূত-প্রেতের কথা বলছ! বিশ্বাস করো ওসব?'
'জিনে বিশ্বাস করি। পবিত্র
কোরআনে আছে। এটা বিশ্বাস না করলে... এই! কোথায় যাচ্ছ তুমি?'
'ছাদে।'
'ছাদে মানে!'
'ছাদ চেনো না? ছাদে কী আছে
দেখতে যাচ্ছি!' বলেই স্বামীকে আর দ্বিতীয় কথাটি বলতে না দিয়ে হন হন করে রুম ছেড়ে
বেরিয়ে গেলেন তিনি। মামনুন শফিকও আর কী করেন, স্ত্রীর পিছে পিছে ছাদের সিঁড়ি ভাঙা
আরম্ভ করলেন।
ছাদে পৌঁছানো যেন নয়, বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে গেলেন দুজনে। বাহারি ফুলের টব, বেতের
চেয়ার-টেবিল, একটা সাদা ধবধবে রং করা দোলনা—সব মিলিয়ে যেন এক বেহেশতি আয়োজন।
বাড়ির আগের মালিকের কথা ভেবে
অবাক হলেন মামনুন। ভদ্রলোক আজব তো, একটা কিছুও সরিয়ে নেননি! নাকি... যাওয়ার আগে ছাদেই
আসেননি? কিন্তু কেন? ছাদে তাঁর এত অনাগ্রহ কেন? আমাদেরই বা ছাদে আসতে নিষেধ করলেন কেন?
হঠাৎ চমক ভাঙে স্ত্রীর কথায়,
“কাণ্ড দেখেছ! এমন সুন্দর ছাদে কিনা আসতে নেই! আমি তোমার ওসব ডং চং শুনব না, বাপু।
প্রতিদিন বিকেলে আমি আমার ছাদে আসব।” বলতে বলতে তিনি দোলনায় বাচ্চাদের মত জোরে জোরে
দুলুনি খেতে লাগলেন। সুখ মানুষের বয়স কমিয়ে দেয়—বাড়িয়ে দেয় দুঃখ।
‘ওই দেখো! কী সুন্দর!’ মামনুন
শফিকও স্ত্রীর দেখাদেখি ওদিকে তাকালেন। এ বাড়ির চারপাশে অনেকগুলো বাড়ি। এদিকে সোজাসুজি
দু-তিনটা বাড়ি পরেই একটা দোতলা বাড়ি। ওটার ছাদে ফুটফুটে চেহারার একটা মেয়ে বল নিয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর পিছে পিছে একজন শুকনো মত মহিলা খাবারের বাটি হাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন।
ঝামেলার ব্যাপার। এতে সুন্দরের
কী আছে—তিনি ভেবে পান না।
‘কী আশ্চর্য! মেয়েটা আমাকে
হাত নেড়ে ডাকছে! ও কী করে বুঝল যে আমরা ওকেই দেখছি?’
‘বাচ্চারা সব বোঝে। শুধু ম্যাডাম,
আপনি বুঝলেন না আমার পেটের ভেতর ছুঁচো নাচছে, ওটাকে থামানোর একটা ব্যবস্থা তো করা উচিত,
নাকি!’
'আহারে বেচারা! চলুন!' মুচকি
হেসে দুলুনি থামালেন। উঠে পড়লেন লাবণী।
সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে আসতে
আসতে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েন মামনুন শফিক। কেমন যেন একটা খটকা লাগে মনে। না, স্ত্রী
বলার আগ পর্যন্ত এক পলকও দৃষ্টি সরাননি মেয়েটার ওপর থেকে। তাঁর নিজেরও দেখতে ভাল লাগছিল
পরীর মত মেয়েটাকে। কিন্তু... এদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল কখন?
মামনুন শফিক তখনও জানেন না,
তাঁর বিস্ময় এ রূপ নিতে বেশি সময় নেবে না।
দুই
মাঝামাঝি জিনিসটাই অদ্ভুত।
মনকে কেমন যেন করে দেয়।
কেউ বলতে পারবে না মধ্য দুপুরে
মনটা আপনিতেই উদাস হয়ে যায়। মধ্য রাতও তেমন। কেমন যেন রহস্য আর ভাবালুতা ভর করে।
একা একা শুয়ে নানা কথা ভাবতে
ভাবতে মনকে মানানোর চেষ্টা করতে লাগলেন লাবণী। স্বামী স্টাডি রুমে। ঘর গোছানোর কাজে
হেল্প করায় সে সময় দিতে পারেননি। কাল নাকি কোনও এক বিধবার কেস কোর্টে উঠবে—সম্পত্তি
সংক্রান্ত জটিলতা। আজ সারা রাত ও জেগে কাটিয়ে দেয়া বিচিত্র নয়।
কাজ, কাজ আর কাজ! বোকা লোকটা
ভুলেই গেছে যে আজকে তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন!
মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
ঘুমাতে চেষ্টা করলেন তিনি।
ঘুম এসেও গেছিল প্রায়। হঠাৎ
ভেঙে গেল। ঠাহর করেও বোঝা গেল না ঘুম ভাঙার কারণ কী। শুধু একটা গন্ধ পেলেন—কোনও কিছু
পোড়ার গন্ধ। তিনি শতভাগ নিশ্চিত চুলায় কিছু পুড়ছে না। প্রতি রাতে চেক করেই ঘুমুতে
আসেন। আর পতিদেবতা—এক কাপ চা করা তো দূরে থাক, জীবনে কোনওদিন চুলায় ম্যাচ জ্বেলে দেখেছে
কি না সন্দেহ আছে। চরম বিরক্তি নিয়ে তিনি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
চুপ... চুপ-চুপ...
চমকে উঠে বিছানায় বসেন তিনি।
এবার বুঝতে পারলেন ঘুম ভাঙার কারণ কী। পেরেক ঠোকা হচ্ছে নাকি! পেরেক ঠোকার মত ভোঁতা
শব্দ হচ্ছে কোথা থেকে? তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে স্বামীর স্টাডিরুমের দিকে রওনা
হলেন তিনি। রাত-বিরাতে পেরেক ঠোকার রহস্য জানা উচিত।
ডাইনিং পেরোতেই দ্বিতীয়বারের
মত চমকাতে হলো তাঁকে। স্টাডিরুমে আর যাওয়া হলো না। তাড়াতাড়ি ডাইনিং-এর লাইট জ্বেলে
দিলেন।
ভীষণ বিস্ময় নিয়ে তিনি দেখতে
থাকলেন—আজ দুপুরে পাশের ছাদে দেখা সেই ফুটফুটে মেয়েটা তাদের ডাইনিং টেবিলের নিচে বল
নিয়ে বসে! হাতে একটা পিতলের ফুলদানি। সেটা দিয়েই মেঝেতে ঠুক ঠুক করছে। এটার শব্দই
পেরেক ঠোকার আওয়াজ ভেবে তিনি ভুল করছিলেন এতক্ষণ।
বড় বড় চোখ করে খানিকক্ষণ
তাঁর দিকে চেয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মন দিল মেয়েটা। থেকে থেকে বিড় বিড় করে কিছু
বলছেও যেন। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি তড়িঘড়ি করে স্টাডিরুমের
দিকে গেলেন। স্বামী মস্তসমস্ত বই টেবিল জুড়ে খুলে রেখে তার উপর মাথা রেখে পড়ে পড়ে
ঘুমাচ্ছেন। কাল বিলম্ব না করে তাঁকে ঠেলে উঠানো হলো।
'শুনছ? এই, ওঠো! ওঠো বলছি!!'
'কীক্ কী হলো?' ধড়মড়িয়ে
উঠে বসতে বসতে বললেন তিনি।
'দেখবে, এসো!'
ডাইনিং রুমে এসে চোখ কপালে
উঠে গেল মামনুনের। ঘোড়ার মত চিহিচিঁহি করে কোনওমতে বলতে পারলেন, 'এই মেয়ে! তুমি এখানে
কেন!'
মেয়েটি কোনও উত্তর দিল না।
আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল।
তাজ্জব বনে যান দুজন। এ মেয়ে
ঘরে ঢুকল কখন? ভেবে পান না মামনুনও। ঘরে সিগারেট খাওয়া স্ত্রীর বারণ। তাও নির্ধারিত
দিনে একটা। সেটাই পরম আবেশে নিঃশেষ করার জন্য রাতের খাওয়ার পর পরই ছাদে ছুটতে হয়
তাঁকে। আজও গিয়েছেন। তবে কি মনের ভুলে দরজা বন্ধ করেননি? সে ফাঁকে কি....
কিন্তু এই রাত-বিরাতে মেয়েটা
তার বাসা থেকেই বা বেরুল কেন? তার মা কি তাকে খুঁজছে না? রাজ্যের চিন্তা মাথায় এসে
ঘোঁট পাকায় তাঁর।
'এই? তোমার মা কোথায়? তাকে
না বলে এই রাতে বাসা থেকে বের হয়েছ—এটা কি ঠিক?'
হাতের ফুলদানিটা মেঝেতে ঠুক
ঠুক করতে করতে বলল মেয়েটা, 'মার জন্য অপেক্ষা করছি।’ বলেই পুট করে ডাইনিং টেবিলের
নিচ থেকে বের হয়ে এল সে।
ভীষণ বিরক্তির উদ্রেক হলো
মামনুন শফিকের মনে। ওর মার জন্য আমাদের ডাইনিং-এর তলে অপেক্ষা করছে মানে কী! এসব কী
ধরনের ঢং!
‘চল মেয়ে। তোমাকে দিয়ে আসি।
তোমার মা এত রাতে তোমাকে ছাড়ল কোন আক্কেলে জেনে আসি। হারিয়ে যেতে যদি!’
মেয়েটা কোনও উত্তর দিল না,
কেমন আর্দ্র চোখে তাকিয়ে থাকে লাবণীর দিকে।
লাবণীও তাতে সিক্ত হন। ওকে
বকছ কেন?’
পরক্ষণে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে
বললেন, ‘তুমি আমার কাছে এসেছ, না? ছাদ থেকে আজ হাত নাড়লে... আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’
মেয়েটা সে কথার কোনও উত্তর
না দিয়ে বরং হঠাৎ চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল, সে অবস্থাতেই বলল, “আগুন।”
‘আগুন!!’ চমকে ওঠেন দুজনে।
‘কোথায়?’ ভূতে পাওয়ার মত
জানতে চাইলেন মামনুন।
মেয়েটা সে কথার উত্তর না
দিয়ে আবার বলল, ‘আগুন’।
কেমন যেন খটকা লাগে ওঁদের
দুজনেরই। সত্যি। পোড়া গন্ধ আসছে যেন কোত্থেকে। সম্ভাব্য উৎস আন্দাজ করে দুজন দুদিকে
ছুটলেন।
আগুন লেগেছে লাবণীর ঘরে। খাটের
পাশে পাপোশে। মশার কয়েল কাত হয়ে আছে কাপড়ের পাপোশের ওপর। কয়েলটা সুদ্ধ মেঝেতে যম
পোড়া পুড়ছে সেটা। বিছানার চাদর এলিয়ে ছিল মেঝেতে, আগুন তাতে লেগেছে। আগুন ছড়িয়ে
পড়ার আগেই পানি ছিটিয়ে আগুন নিভিয়ে একটু ধাতস্থ হতেই মনে পড়ে গেল মেয়েটার কথা,
আশ্চর্য ঘ্রাণ শক্তি তো মেয়েটার। ভাল কথা, কোথায় ও?
দুজনেই হস্তদন্ত হয়ে ডাইনিং
রুমে এসে আবিষ্কার করলেন মেয়েটা গায়েব! লাবণীই আবিষ্কার করলেন জানালা দিয়ে, ‘ওই
দেখো!’
মেয়েটা একা একা ফিরে যাচ্ছে।
ওদের বাড়ির দিকেই। এবং সাথে ওর মা নেই।
‘পারবে তো ফিরে যেতে! তুমি
একটু এগিয়ে দিয়ে এসো না।’
স্ত্রীর আবদারে মেজাজ খারাপ
হয় মামনুনের।
‘পারবে ছাড়া কী! আসতে যখন
পেরেছে তখন যেতেও পারবে। কাল ও বাড়িতে গিয়ে মহিলার সাথে কথা বলে আসব। আর ভাল করে
চেক করে দেখো কিছু চুরি টুরি করেছে কিনা। ফুলদানিটা আমাদের ছিল নাকি?’
লাবণী মন খারাপ করা দৃষ্টি
নিয়ে স্বামীর দিকে চাইলেন।
‘তুমি এসব নিয়ে অত বাজে চিন্তা
করে প্রেশার বাড়িও না। চল ঘুমুতে যাই।’
এবারে যেন ক্ষেপে গেলেন লাবণী,
‘বাজে চিন্তা আমি করছি, না তুমি? ফুলদানি মোটেও আমাদের না। আর তুমি ওকে চোর বলছ? অথচ
দেখো, আজকে মেয়েটা কত বড় উপকার করেছে! তোমার দাদীর দেয়া খাট, পুড়ে গেলে এমন স্মৃতি
টাকায় কিনতে পারতে?’
মামনুন কোনও উত্তর দিলেন না।
এবং শুনতেও পেলেন না, ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে কোথাও। অশনি ঘণ্টা।
তিন
রহস্যময় মেয়েটার বাড়িতে
মামনুন শফিকের আর যাওয়া হলো না। চার-পাঁচ দিন কেস নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ব্যস্ততা যখন
শেষ হলো তখন তিনি আবিষ্কার করলেন অন্যকিছু—
তাঁর স্ত্রী লাবণী চব্বিশ
ঘণ্টায় প্রায় পনেরো ঘণ্টাই ছাদে কাটায়! কিছু না। শুধু বসে থাকে। আর এক দৃষ্টিতে
সেদিনের সেই রহস্যময় মেয়েটার বাড়ির ছাদের দিকে চেয়ে থাকে। স্ত্রীকে এ ব্যাপারে
কিছু বললেন না তিনি। এমন ভান করতে লাগলেন যেন এসব কিছু তাঁর নজরেই পড়ছে না।
কিন্তু তাঁর এ ধরনের আচরণের
কোনও মানেও খুঁজে পেলেন না। এমনও তো হতে পারে, তাঁর কোনও কথায় মনে কষ্ট পেয়েছে—এমন
অসম্ভব ধারণাও তাঁর মনে উঁকি দিতে ছাড়ে না। যদিও আজ দীর্ঘ এগারো বছরের সংসার জীবনে
স্ত্রীকে কোনও কটু কথাই বলেননি তিনি। কিংবা বলা যায়, ওকালতির ব্যস্ততা তাঁকে সে সুযোগ
দেয়নি।
তিনি পুরো পরিস্থিতিকে তাঁর
আপনার মত ছেড়ে দিলেন। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু না।
পরিস্থিতি স্বাধীনতা পেয়ে
আপন খুশিতে নিজেকে আরও ঘোলাটে করে তুলল।
বিকেলে ছাদে উঠেছিলেন। কোনও
শব্দ না করে চুপি চুপি স্ত্রীর পেছনে এসে দাঁড়ালেন।
ভীষণ অবাক হলেন তিনি। শুনতে
পেলেন স্ত্রী বিড়বিড় করে কী যেন আপন মনে বকছেন। তিনি কান খাড়া করে যেটুকু উদ্ধার
করতে পারলেন সেটা এরকম দাঁড়ায়—
‘এই! তুই কাল রাতে ওভাবে চলে
গেলি কেন?’
ক্ষণিকের বিরতি।
‘না। ও রকম আমি খাই না।’
আবার বিরতি।
‘ঠিক আছে। আমি তোকে বানিয়ে দেব।’
বিরতি।
‘আমাকে মা বানাতে চাস? হব! হব!!’
বিরতি। ভীষণ একটা কষ্টে লাবণীর দুই ভ্রু কুঁচকানো।
‘এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি! কাল কখন আসবি?’
হতভম্ব মামনুন দূরের ছাদের
দিকে তাকান। শেষ বিকেলের আলো খেলা করছে সব ছাদে। নির্দিষ্ট ছাদটায় যার থাকা নিয়ে
এ মুহূর্তে তাঁর বিচলিত হওয়ার কথা, সে-ই নেই। শুকনো মত মহিলা, সম্ভবত মেয়েটার মা—সেও
নেই।
তিনি বিব্রতভাবে স্ত্রীর সামনে
এসে দাঁড়ান। আশ্চর্য! স্ত্রী খেয়ালও করল না যেন! যেন তাঁর কোনও অস্তিত্বই নেই। সেই
একই অন্যমনস্ক দৃষ্টি, আর থেকে থেকে বিড়বিড়।
এতটাই সন্তান লালসা ভেতরে
জিইয়ে রাখছিল সে, চিন্তা করতেই ভেতরটা কুঁকড়ে যায় তাঁর। সেই লালসা রাখতে রাখতে বউ
এখন পাগলপ্রায়। পরের একটা মেয়ে তার কল্পনায় এসেও মা ডাক শোনাচ্ছে। সন্তানের জন্য
এতই হাহাকার ছিল তো সে মুখ ফুটে কোনওদিন বলেনি কেন।
স্ত্রীর অন্যজগতে ভেসে যাওয়া
চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথা কুটে মরতে ইচ্ছে হলো তাঁর। দত্তক সন্তানও
লাবণীর মাতৃত্ব ঘোঁচাতে পারত!
নাহ!
ওকালতি তাঁর শেষ জীবনটাও খেল। বছর আটেক আগে দত্তক নেয়ার চিন্তাটা মাথায় আসলে ওরকম
একটা মেয়ে এখনই তাকে মা মা করে অস্থির করে তুলতে পারত।
হঠাৎ চমকে ওঠেন তিনি, সমস্ত
শরীরে প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এ কী দেখছেন তিনি!
এতক্ষণ স্ত্রীর চোখের দিকে
তাকিয়ে আছেন, অথচ একটিবারের জন্যেও তাকে পলক ফেলতে দেখলেন না! কী করে সম্ভব হচ্ছে
এটা—এতক্ষণ পলক না ফেলে থাকা!
এই লাবণী? লাবণী! তাকাও তাকাও
আমার দিকে। এই!
যেন কাঁচা ঘুম থেকে প্রবল
ধাক্কায় হঠাৎ জেগে ওঠার মত—প্রচণ্ড ভাবে লাফিয়ে উঠলেন লাবণী। বোকার মত খানিকক্ষণ
আশপাশে তাকালেন। তারপর আপন মনেই বললেন,
‘ওহ্।’
‘কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ
লাগছে?’
‘না তো। তুমি কখন ছাদে এলে?’
মিষ্টি হেসে বললেন তিনি। তারপর চার পাশে তাকিয়ে একটু মন খারাপ করলেন যেন—
‘দেখলে, বেলা কত পড়ে এল, পুরি রেডি করে রেখেছিলাম, জাস্ট শুধু ভাজব। ভেবেছিলাম ছাদে
বসে গরম পুরি আর চা খাওয়াব তোমাকে। ইস! আমি যে একটা কী!’ বলতে বলতে লজ্জিত হেসে দোলনা
ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি।
‘থাক। নিচে চল। আজ বাসায়ই
খাই। আমার স্টাডিও এখন শেষ হয়নি।’ এতক্ষণ ছাদে যা ঘটল তা কোনও ভাবেই স্ত্রীকে জানালেন
না তিনি।
সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসার সময়
ও ছাদের দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ করেই বুকটা কেঁপে উঠল তাঁর।
চার
পরিস্থিতি অনেকভাবে থামাতে
চেষ্টা করেছিলেন মামনুন। লাভ হয়নি। সেটা ঘোলাটে থেকে বরং প্রস্তর কঠিন রূপ লাভ করেছে।
স্ত্রীর বিড়বিড় করে কথা
বলা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে। তনু তনু বলে কাকে যেন ডাকে।
দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্নাঘরে
উঁকি দিলেন তিনি। স্ত্রী সকালের নাস্তা রেডি করছে। থেকে থেকে বিড়বিড়ও। ডিম পোচের
প্লেটের দিকে তাকিয়ে মেজাজ খারাপ হলো তার।
আজ টানা তিন দিন ধরে এ অবস্থা।
সব কটা ডিমের মাঝখান থেকে গোল করে কুসুম উধাও! ধারণা করে নিলেন সে মেয়েটার জন্যই।
সে নিশ্চয় কুসুম খায় না?
আশ্চর্য! মেয়েটা তাকে এত
অধিকার করে নিল!
সেই রাতের পর আর দেখেননি ওকে
এ বাড়িতে। তা হলে নিশ্চয় মাঝে মধ্যে ওর মায়ের সাথে এসেছে। তা না হলে ও কী খায় না
খায় তা পর্যন্ত ওর নখাগ্রে থাকবে কী করে?
কিন্তু ওর কথা একবারও তো বলল
না লাবণী!
রান্নাঘর থেকে সরে আসতে আসতে
মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। মেয়েটার বাড়ি যাবেন ভেবেছিলেন। কেসের ঝামেলায়
তাঁর যাওয়া হয়নি। আজ সিদ্ধান্ত নিলেন সে বাড়ি ঘুরে আসবেন। নাস্তা করার আগেই। এ মুহূর্তেই।
ঝটপট কাপড় বদলে স্ত্রীকে
কিছু না জানিয়েই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। মলিন হয়ে আসা আকাশী রঙের দোতলা বাড়িটা খুঁজে
পেতে তাঁর সময় লাগল না।
গেটের তালা খোলা। গ্যারেজের
জন্য জায়গা রেখে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে। সেটা ধরে উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন
তিনি।
অমনি থমকাতে হলো তাঁকে।
পেছন থেকে একটা আওয়াজ তাঁকে
থামিয়ে দিল।
‘এই যে, ভাই? কোথায় যাচ্ছেন?’
পেছন ফিরে তাকাতেই তিনি দেখতে
পেলেন এক লোককে। গেটের বাইরে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে। মধ্যবয়স, ডিম্বাকার টাকের ওপর তুড়ি
বাজাচ্ছে। কাঁচাপাকা গোঁফ আর চৌকোনা মুখ মিলে কেমন একটা সৌম্য চেহারা। লোকটা বাজারের
ব্যাগ হাতে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
‘পাগল নাকি আপনি? উপরে কোথায়
উঠছেন?’
‘ইয়ে...’ কী বলবেন ভেবে পান
না মামনুন।
‘এলাকায় নতুন?’ আত্মবিশ্বাসের
সাথে প্রশ্ন আসে।
'হুম।'
সিঁড়ির তিন ধাপ ভেঙেছিলেন। আবার নেমে লোকটার সামনে আসেন। দোনো-মনো করে শেষে বলেই ফেললেন,
'এই বাড়িতে একটা ছোট্ট মেয়ে আছে না?'
'আছে নয়, ছিল।'
'মানে!'
'তনু নামের একটা মেয়ে ছিল।
তার মা, বাবা আর দাদী মিলে থাকত। খুব খারাপ একটা ঘটনা ঘটায় ওরা চলে গেছে এখান থেকে।
সেও প্রায় আজ দু’বছর হতে চলল।'
মাথা বোঁ করে ঘুরে উঠল এক
পাক। তনু! এ নামটাই তো স্ত্রীর মুখে শুনছেন আজ কদিন। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে
পারলেন,
'খারাপ ঘটনাটার কথা জানতে পারি?'
'অবশ্যই। কেন নয়? এলাকার
মানুষ হিসেবে আপনাকে জানানো তো আমার কর্তব্য। তবে এখানে নয়। চলুন, সামনে এগোতে এগোতে
বলা যাক।'
আড়ষ্ট হয়ে আসা পা চালিয়ে
লোকটার সাথে চলতে বড় কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। সে অবস্থায় শুনতে থাকলেন পুরো ঘটনা—
“এলাকায় মিষ্টি মেয়ে তনু
খুব পরিচিতি পেয়েছিল। সাত বছর বয়স। হড়বড় করে কথা বলত। বাবা ব্যাংকে চাকরি করত।
ওর মা আর দাদী থাকত বাসায়। খুব সুন্দর একটা পরিবার। কিন্তু মহিলাই ছিল যত নষ্টের মূল।
ওদের বাসার নিচতলায় ব্যাচেলর ভাড়াটে থাকত। সে লোকের সাথে মহিলার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে
উঠেছিল। কেউ জানত না। অসুস্থ শাশুড়ি নিজের ঘরেই থাকতেন বেশিরভাগ সময়।
তনুই একদিন দেখে ফেলে। অন্য
লোকের সাথে মাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে খুব কান্নাকাটি করে। পরে বাবা অফিস থেকে এলে
বাবাকে বলে দেবে বলে চেঁচাতে থাকে। হঠাৎ হতভম্ব হয়ে গিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে
মহিলা খাটের উপর থেকে বালিশ এনে মেয়ের মুখের উপর চেপে ধরেন।
শ্বাস বন্ধ হয়ে মেয়ে তড়পাতে
থাকে। বালিশ তুলে যখন দেখলেন মেয়ে মরেনি, তখন হাতের কাছে থাকা পিতলের শো-পিস নিয়ে
মেয়েটার মাথায় বাড়ি দিয়ে শেষমেশ মেরেই ফেলেন।*
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে
লোকটার,
'বুঝলেন ভাই, হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ায় মহিলা এমন ভয়ঙ্কর কাজ করেছে। শেষে নিজেই
পুলিশ ডেকে পুলিশের কাছে ধরা দিলেন। কিন্তু তাতে কী? অমন ফুলের মত মেয়েটা তো আর ফিরে
এল না। সে বছরই তনুর বাবা এ বাসা ছেড়ে দেন।
আচ্ছা ভাল কথা, আপনি তনুর
ব্যাপারে এসব জানেন না, অথচ তনুকে চিনলেন কী করে?'
আসল দরজায় কড়া পড়ায় এবার
মামনুনের নিজেরই অপ্রস্তুত অবস্থা।
'না মানে... জানি। ঠিক পুরোটা
জানতাম না। ওই যে! আমার বাসা।'
তাঁর বাসা দেখিয়ে দিয়ে কথা
এড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি।
'চলুন না। এক কাপ চা খাবেন।'
'না না ভাই, বাজার করা লাগবে।
দেরিতে গেলে ভালো পাব না। আরেকদিন আসব না হয়।'
'আসলে খুব খুশি হব। আপনাদের
এলাকায় এসেছি, চিনপরিচয় থাকা ভালো।'
'সে আসা যাবে। কিন্তু ভাই,
একটা কথা—বিশ্বাস করি না, তাও লোকের কাছে শোনা বলেই বলছি—ও বাড়ির ধারে কাছে যাবেন
না।'
'কেন?'
'বাড়িটা ভালো না। খুনে বাড়ি।'
গলা নামিয়ে বললেন লোকটা,
'মাঝে মাঝে নাকি পিচ্চি মেয়ের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে।
আমি অবশ্য শুনিনি কখনও। তারপরও... সাবধান থাকা ভালো, বুঝলেন না?'
'হুম।'
ভীষণ একটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন মামনুন।
'তো ঠিক আছে। আজ চলি তা হলে।'
'আসবেন কিন্তু।'
'হুঁ। হুঁ। অবশ্যই।'
লোকটা হন হন করে বাজারের দিকে
হাঁটা দিয়ে তাকে আরও বেশি অপ্রস্তুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।
ক্লান্ত পায়ে বাসায় ফেরেন
তিনি। মনের উপর দিয়ে মস্ত একটা ঝড় বয়ে গেছে। সহজেই বুঝতে পারছেন—এ বিধ্বস্ত অবস্থা
সারিয়ে তুলতে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
মেয়েটা যদি দু’বছর আগে মারা
গিয়ে থাকে, তা হলে ছাদে দেখা কী করে সম্ভব... আর স্ত্রীই বা তা হলে কী করে জানল যে
মেয়েটার নাম তনু...
সব ওই লোকের কথার সাথেই মিলে যাচ্ছে। তা ছাড়া, ওই রাতে মেয়েটার হাতে পেতলের ফুলদানি
ছিল—আজ লোকটাও বলল, ওটা দিয়েই নাকি ওর মা... কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে।
লোকটার কথাই যদি ঠিক হয়! প্রেতাত্মা
হতে হয়তো ও বাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। তাই এখনো তাকে দেখা যায়—গল্প-উপন্যাসে যেমনটা
হয়। কিন্তু যদি এই অসম্ভব জিনিসটা সম্ভব হয়, তবে আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে—মনে মনে
ভাবলেন তিনি।
তা হলে ধরে নিতে হবে, তাঁর
স্ত্রীর উপর সেই প্রেতাত্মা ভর করেছে!
ধরে নিতে হবে, সেদিন সিগারেট খেয়ে ছাদ থেকে ফিরে তিনি অবশ্যই দরজায় ছিটকিনি দিয়েছিলেন।
ধরে নিতে হবে, ওই প্রেতাত্মাই সেদিন আগুন লাগিয়েছিল লাবণীকে মারার জন্য—যেভাবে বিছানার
চাদরে আগুন লেগেছিল! লাবণী তো বলেছিল, ঘুমানোর সময়ও পোড়ার গন্ধ পেয়েছিল সে।
“নাহ! কী সব বিশ্রী ভাবনা!”
বিরক্ত মুখে তিনি আরও দ্রুত সিঁড়ি ভাঙেন।
ডাইনিংয়ে নাশতা রেডি। তিনি
এসে চেয়ারে বসতেই স্ত্রী টি-পটে চা নিয়ে হাজির। তাঁর চোখে এখনও ঘোলাটে দৃষ্টি, বিড়বিড়
করছেন। কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মনের ভেতর কেমন এক অশনিসংকেত
বেজে উঠল। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল তাঁর।
"লাবণী?" ডাকলেন
তিনি।
যেন শুনতেই পেল না তাঁর স্ত্রী।
"লাবণী!" আরও জোরে
ডাকলেন তিনি।
এবার যেন হুঁশ ফিরল তাঁর।
প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। এখন সব স্বাভাবিক। খাবারের প্লেটের
দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলেন তাঁর স্ত্রী।
"একী! তুমি এ অভ্যাস
শুরু করেছ কখন থেকে? এ কদিন প্রায়ই দেখছি ডিমের কুসুম আগে খেয়ে ফেলো। আমারটাও! কুসুম
ছাড়া ডিম দেখতে কেমন বিচ্ছিরি দেখায় না?"
"আর খাব না।" হাসার
চেষ্টা করেন মামনুন।
"এই সাত সকালে কোথায়
যাওয়া হয়েছিল স্যারের?’
বাটার লাগানো পাউরুটিতে কামড় বসাতে বসাতে বললেন লাবণী।
'এই তো... একটু হাঁটতে। এ
কদিনের কাজের চাপে মাথা খারাপের মত অবস্থা, তাই একটু ফ্রেশ হতে।'
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু
ভাবলেন তিনি। একটু কায়দা করে ওই মেয়েটার প্রসঙ্গ তুললেন,
'আচ্ছা লাবণী, ছাদে দেখা ওই
মেয়েটা—ওই যে, সেদিন আমাদের বাসায় ঘাপটি মেরে বসে ছিল, ও কি আর এসেছিল নাকি এ বাসায়?'
'কই, না তো? ছাদেও ইদানীং
আর ওঠে না। শুকনো মত ওই মহিলাটাও না।'
'ও।'
আর কিছু বললেন না তিনি। চুপচাপ
নাস্তা খেতে লাগলেন। ভাবলেন, মেয়েটা বুঝি তার কল্পনাতেই আসে! স্বাভাবিক অবস্থায় যখন
থাকে, তখন তো বউ একেবারে সুস্থ।
মনে মনে সিদ্ধান্তটা নিয়েই
ফেললেন—এ বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাবেন। গোল্লায় যাক বাড়ি। স্ত্রীকে নিয়ে বহুদূরে
চলে যাবেন তিনি, যেখানে তনু নামটা স্ত্রীর কানে বাজার চেষ্টা করবে না।
খেতে খেতে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ
সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি—এবার একটা বাচ্চা দত্তক নেবেন।
পাঁচ
রহস্যনামচার অধ্যায় শেষ ভেবেছিলেন।
এবার আবিষ্কার করলেন তার শুরু।
মামনুন শফিক যখন বাসায় ফিরে
এলেন তখন বিকেল চারটা। পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আচানক মনটা ভালো হয়ে গেল তাঁর।
কারণ, অনেকগুলো ভালো ব্যাপার
আবিষ্কার করলেন তিনি।
প্রথমত, স্ত্রীর মধ্যে সব
সময় যে অন্যমনস্ক একটা ভাব থাকত, সেটা চলে গেছে।
দ্বিতীয়ত, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
ছাদে থাকছে না। চমৎকার গৃহিণীপনা সারছে।
পরপর দুদিন এ রকম ঘটল। মনে
মনে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি। যাক, সব ঠিকঠাক হয়ে যাচ্ছে তাহলে।
বাড়ি বিক্রির কথা শুনে তাঁর
উকিল-বন্ধু এ বাড়িটা কিনবে বলেছিল। মাঝখানে যে কদিন ছুটি পাওয়া যাবে, তার মধ্যে দূরে
কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। সেন্টমার্টিন—হ্যাঁ, লাবণীর প্রিয় জায়গা।
"বান্দরবান গেলে কেমন
হয় বল তো? অনেকদিন যাওয়া হয় না। তোমার প্রিয় জায়গা।"
স্ত্রীর কথায় হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলেন তিনি। চা খাচ্ছিলেন, খানিকটা ছলকে পড়ল জামায়।
কী কাকতালীয়! এমনটাই তো তিনি ভাবছিলেন এতক্ষণ। যাক, ছয়ে ছক্কা মিলে গেল!
তাঁকে চুপচাপ দেখে লাবণী বলে
উঠলেন, "লামায় যাওয়া যায়। ঘুরে আসাও হলো, রিপা-আরিফকেও দেখে এলে। রিপার বাচ্চাটা
এখন স্কুলে পড়ে, ক্লাস ফোরে।"
মাথায় যেন পুরো আকাশ ভেঙে
পড়ল মামনুন শফিকের। সাদাটে কাগজের মতো হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে
থাকেন তিনি। রিপার কথা এ জানল কী করে? কখনও তো বলা হয়নি!
রিপা—তাঁর স্কুলজীবনের সহপাঠী,
পরবর্তীতে প্রেমিকা। ভার্সিটি পর্যন্ত পাশে ছিল। ওর প্রতি গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন
তিনি। একতরফা প্রেম। পরে যখন ভেবেছিলেন রিপাকে নিয়ে জীবন সাজাবেন, তখনই জানতে পারেন
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আরিফ এরই মধ্যে প্রেম নিবেদন করে ফেলেছে—এমনকি দুই পরিবারের
মধ্যে বিয়ের কথাও পাকা!
আরিফ সেদিন হেসে হেসে বলেছিল, "সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, তাই এতদিন বলিনি।"
সেই রিপা। সেই আরিফ। তাদের
সন্তান।
কিন্তু লাবণীর তো এসব জানার কথা নয়! কোনওদিন ডায়েরিতেও লেখেননি, তাহলে? রিপাই কি…?
"কী ভাবছ?" ভ্রু
নাচিয়ে জানতে চাইলেন লাবণী।
"কিছু না। মানে… তুমি…" মামনুন শফিকের মুখে কথা আটকে গেল। না, এটা কোনো পুরোনো
প্রেমের নাড়াচাড়া নয়—বরং অন্য কিছু, আরও বড় আশঙ্কা।
এবং সেই আশঙ্কা তৎক্ষণাৎ সত্যে
পরিণত হলো।
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে রহস্যময় হাসি দিলেন লাবণী।
"তুমি গত মাসে রিপার সাথে বসুন্ধরা সিটিতে দেখা করতে গিয়েছিলে। আমাকে বলোনি।
কিন্তু আমি সব জানি।"
"কীভাবে!" থতমত
খাওয়া মুখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কথা সত্যি। রিপা ওর দেবরের বিয়ের কেনাকাটার জন্য ঢাকা এসেছিল। কোনও এক অদৃশ্য টানে
তিনিও বসুন্ধরা সিটিতে গিয়েছিলেন। আরিফও ছিল সেখানে। সে-ই পুরো ব্যাপারটার আয়োজক।
তবুও… শুধু চোখের দেখা!
কিন্তু স্ত্রীর কাছে খবরটা
পৌঁছাল কীভাবে?
"বলবে না? কে বলেছে তোমাকে
এসব?"
অস্থির হয়ে জানতে চাইলেন তিনি।
"ও বলেছে।" এবার যেন খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন লাবণী। চোখের দৃষ্টিও বদলে
গেছে—নিষ্পলক, কঠিন।
কোনো কথা না বলে উঠে পড়লেন
মামনুন। বেডরুমের দিকে গেলেন।
কিন্তু সত্য জানতে চাইলেও সাহস হলো না স্ত্রীর সাথে এ নিয়ে কথা বলার। তিনি নিজের স্টাডিরুমে
ফিরে এলেন।
তাতে লাভ হলো। মনের ভার আস্তে
আস্তে হালকা হতে লাগল। অস্বস্তি ভুলে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে ওকালতির বইপত্র নাড়াচাড়া
করতে লাগলেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে কখন রাত নামল, টেরও পাননি।
নিমগ্ন হয়ে পড়লেন পড়ায়।
দেয়ালঘেঁষা তাক থেকে হাত বাড়িয়ে বই খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু যেটা খুঁজছিলেন, সেটা
না পেয়ে অন্য কিছু হাতে এল—বইয়ের মতো, কিন্তু বই নয়।
তিনি বিস্ময়ে পাতা উল্টালেন।
চমকে উঠলেন। বুকটা দুরুদুরু কাঁপে উঠল। অসম্ভব!
মামনুন শফিকের হাতে এ মুহূর্তে
বই নয়—অ্যালবাম। ছবিতে ভরা। এ বাড়ির আগের মালিকের অ্যালবাম।
ছবিতে ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী, সন্তান।
সব সাধারণ ছবি, কিন্তু একটায়
থমকে গেলেন।
ভদ্রলোকের পাশে যে মহিলা, সেই মুখটাই তিনি দেখেছিলেন সেদিন ছাদে থাকা মেয়েটার সাথে
থাকা মহিলার মধ্যে। একই রকম শুকনো, পাতলা, বব-কাট চুল। সব এক!
ছবিগুলো একে একে দেখতে লাগলেন।
একটার পর একটা—সব এক!
কিন্তু তো তিনি জানেন, সেই মহিলা তো মারা গেছেন!
চমকাতে চমকাতে মাথায় যেন
বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল।
তৎক্ষণাৎ পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
অসম্ভব হলেও যুক্তি দাঁড়
করাতে চাইলেন তিনি—
প্রথম দিন ছাদে আর রাতে বাসায় দেখা মেয়েটি তনু নামের সেই মেয়ের আত্মা! মায়ের হাতে
খুন হয়ে অতৃপ্ত বাসনায় এখনও এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেনি।
কারণ?
সে চায় ভালো মা। যেহেতু তার নিজের মা তাকে খুন করেছিল। তাই সে পছন্দের কাউকে নিজের
জগতে নিয়ে যায়। যেমন নিয়ে গেছে এই বাড়ির আগের মালিকের স্ত্রীকে।
তাই তিনি ছাদে যেতে মানা করেছিলেন?
শিউরে উঠলেন মামনুন। হাতে
ধরা অ্যালবাম কেঁপে উঠল। বিছানার চাদরে যেন আগুন ধরে গেল।
তাহলে ও-ই কি লাবণীর আত্মাকে
নিতে চায়?
রিপার কথা জানে? কী বলেছে ও?
মুহূর্তেই সব ওলট-পালট হয়ে
গেল মামনুনের মনে। দৌড়ে গেলেন বেডরুমে—স্ত্রী নেই! বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
ছাদে দৌড়ে যেতে চাইলেন—পারলেন
না। রুমের মধ্যেই পথ হারিয়ে ফেললেন। কোথায় দরজা, কোথায় সিঁড়ি—সব যেন অচেনা লাগল।
ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি পার হতে
হতে মনে হলো, লক্ষ ক্রোশ পথ পাড়ি দিচ্ছেন।
ছাদে এসে দেখলেন—লাবণী দোলনায় বসে আছেন।
চটজলদি কাছে গিয়ে বললেন, "চলো! ভেতরে যাও! এখানে না! এই বাড়িতেও না!"
কোনো উত্তর নেই।
হতবাক মামনুন খেয়াল করলেন—আজই
প্রথমবার দোলনা দুলছে না।
লাবণীর চোখের দৃষ্টি ও শরীর—দুটোই শান্ত, স্থির।
এবং সে দোলনা লাবণী আর কখনও
দোলাননি।
তথাপি...
ছয়
"বাড়িটা তোমার পছন্দ
হয়েছে?"
দোলনায় দুলতে দুলতে বলল সারাহ।
"বাড়ি না ছাই! কেমন পুরোনো পুরোনো চেহারা। আমার পছন্দ হয়েছে এই ছাদটা—খোলামেলা,
সাজানো… আরে দেখ! ও ছাদের পিচ্চিটা আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে!"
সেদিকে তাকাল ইশতি। কিছুই
চোখে পড়ল না।
"ওই দেখ, আবার হাত নাড়ছে!"
উচ্ছ্বসিত সারাহ।
ইশতি মনে মনে বিরক্ত হলো—তার
স্ত্রী সবকিছু এত বাড়িয়ে বলে!
আসলে মেয়েটা মোটেও হাত নাড়ছে না। দিব্যি বল নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। আর ওর পেছনে খাবারের
বাটি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা মোটা মহিলা—সম্ভবত ওর মা।
শাইয়িন কবির সম্পাদিত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন